কলকাতার ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনই কি পথ দেখাচ্ছে?

কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে
কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে  © বিবিসি বাংলা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ যখন শুরু হয়েছিল, তার কদিন আগেই বাংলাদেশে ঘটে গেছে গণঅভ্যুত্থান। দেশ ছেড়ে চলে গেছেন প্রধানমন্ত্রী, পতন হয়েছে সরকারের। এ আন্দোলনে যেসব স্লোগান শুনেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তার অনেকগুলো শোনা যাচ্ছে ‘রাতের রাস্তা দখল’ বা তার পরবর্তী এক সপ্তাহ ধরে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদী মিছিলে।

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ যেমন শোনা গেছে, তেমনই বিরোধী রাজনৈতিক দল – বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস যে দাবি তুলছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পদত্যাগের, সেখানেও শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের আদলে স্লোগান, ‘দফা এক দাবি এক, মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’। রাজনৈতিক দলগুলির বাইরে নাগরিক সমাজের একাংশের মধ্যেও সে দাবি উঠতে শুরু করেছে।

দিন দশেক ধরে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ চলছে, বুধবারও তা অব্যাহত ছিল। জুনিয়র ডাক্তাররা এদিন বিক্ষোভ মিছিল করে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সদর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিক বিজেপি নেতারা ধর্নায় বসেছিলেন আরজি কর হাসপাতালের কাছে শ্যামবাজারে। বুধবার বিকেলে বিজেপি একটি মিছিল করে, যেখানে বাংলাদেশের আন্দোলনের স্লোগানের ধাঁচে প্ল্যাকার্ড ছিল, ‘দফা এক দাবি এক মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ’।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও প্রাক্তনরা কলেজ স্ট্রিটে জমায়েত করেন। আবার কংগ্রেস নেতা-কর্মীদের একটি বড় মিছিল গিয়েছিল কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের দিকে। মিছিলকারীদের পথ রোধ করে পুলিশ। সে ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা হলে কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ক্রীড়া জগতের মানুষও পথে নেমেছিলেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস ফর আরজি কর’ স্লোগান দিয়ে। বুধবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত একাধিক মিছিল-জমায়েত-প্রতিবাদ হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবাদী চিকিৎসকদের কর্মবিরতি শেষ করে কাজে ফেরার আবেদন করলেও আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই এবং রাজ্য সরকারের যে ‘স্টেটাস রিপোর্ট’ জমা দেওয়ার কথা, সেটা দেখে তারা পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করবেন।

কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে যেমন প্রতিবাদ হচ্ছে, তেমনই ভারতের অন্য শহরেও প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। কলকাতার প্রকাশক দীপায়ন ধর বলছিলেন, ‘আরজি করের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে এখন যে আন্দোলন চলছে, তা কিছুটা তো নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ছাত্রদের আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবে যেভাবে আন্দোলন হচ্ছে, সেটা দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’

প্রতিবাদীদের একাংশ বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের দুটি আন্দোলনের সব থেকে বড় মিল হল রাজনৈতিক পতাকা ছাড়া সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়াটা। অদিতি রায় বলেন, ‘রিক্লেইম দ্য নাইট বা রাতের রাস্তা দখল কর্মসূচির একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াতে প্রথম এ আন্দোলন হয়েছিল। এই যে উই ওয়ান্ট জাস্টিস স্লোগান, সেটা কিন্তু ওই আন্দোলনেরই স্লোগান ছিল। সে ইতিহাস হয়ত অনেকেই জানেন না। তাদের একটা বড় অংশকে সেদিন রাতে পথে নামতে সম্ভবত বাংলাদেশের আন্দোলনই উজ্জীবিত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘যেভাবে সাধারণ মানুষ প্রায় রোজই কোনও দলীয় পতাকা ছাড়া, দলমত নির্বিশেষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামছেন আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে, সেটার পথ দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তারা তো দেখিয়েছেন, এভাবেও সম্ভব! অনেকেই ভেবেছেন যে বাংলাদেশ পারলে আমরা পারব না?’

দীপায়ন ধরের কথায়, ‘কলকাতার একটা প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে কর্তব্যরত অবস্থায় এক চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনামানুষকে ক্ষুব্ধ করেইছে, এর বাইরেও জনমানসে একটা ক্ষোভ দানা বাঁধছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ উগরে দেওয়ার একটা জায়গা খুঁজছিলেন মানুষ। সেটাই এ ঘটনার প্রতিবাদের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশেও সেটাই ঘটেছে।’

কলকাতায় ধর্ষণ-হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশেও আন্দোলন হয়েছে    ছবি: বিবিসি বাংলা

শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত এবং পাকিস্তানে যে আন্দোলন হচ্ছে, সবগুলির ধাঁচ অনেকটা একরকম বলে মনে করছেন কলকাতার তথ্যচিত্রকার সৌমিত্র দস্তিদার। তিনি বলছিলেন, ‘তিনটি দেশের আন্দোলনের মূল সুরটা যদি দেখেন, সবগুলোই কিন্তু অচলায়তন ভাঙ্গার চেষ্টা। সবক্ষেত্রেই একেবারে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন। সব জায়গাতেই এমন বহু মানুষ রাস্তায় নামছেন, যাদের বড় অংশ তরুণ। এদের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

তিনি বলেন, ‘সব জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে একটা স্বতঃস্ফূর্ত জন জাগরণ দেখা যাচ্ছে। কোন দল কী করবে, কী দাবি তুলবে, সেটার অপেক্ষায় মানুষ বসে থাকছে না।এসব আন্দোলন থেকে যে সিস্টেম বদলের আওয়াজ উঠছে, রাজনৈতিক দলগুলোর চেনা আখ্যানের বাইরে গিয়ে, সেটা অবশ্য দেখিয়েছে বাংলাদেশের ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলনই।’

রাজনৈতিক দলগুলো যে তার পদত্যাগ চাইছে এবং কলকাতার আন্দোলনে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জী নিজেও। তিনি সম্প্রতি বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সেদেশের আন্দোলনকারীরা সরিয়ে দিতে পেরেছে – এটা দেখে কলকাতার আন্দোলনকারীরাও উৎসাহিত হচ্ছে, এই ভেবে যে ‘এখানেও পারবে’, তাকেও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে।

আরো পড়ুন: ভারতীয় ঢল-বৃষ্টিতে বন্যা ছড়িয়েছে ৮ জেলায়, আরও বিস্তৃতির শঙ্কা

তার দলও আরজি করের ঘটনা নিয়ে ‘রাম-বাম’বা বিজেপি এবং সিপিআইএমের রাজনীতির কথা বলছে বারবার। দলের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, ‘বিরোধীদলগুলো যে রাজনীতি করবে এ নারকীয় ঘটনা নিয়ে, তা তো জানা কথা। কিন্তু তার বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠছে, তা নজরে আসেনি।

তিনি বলেন, ‘যে ঘটনার বিচার চাওয়া হচ্ছে, এখনও পর্যন্ত যা তদন্ত, যা গ্রেফতারি, সেই সবটাই মমতা ব্যানার্জীর সরকারের পুলিশই করেছে। সিবিআই তো তদন্তভার পেয়েছে দশদিনের বেশি হয়ে গেল। কোনও অগ্রগতি কী তারা করতে পেরেছে? তাহলে মমতা ব্যানার্জীর পদত্যাগ কেন চাওয়া হবে? সিবিআই যে মন্ত্রকের অধীন, তার মাথায় যিনি বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী, তার পদত্যাগ চাওয়া উচিত।

সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারটি তার নজরে না এলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা পোস্ট বা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে, চায়ের দোকানে, আড্ডাতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খবর: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ