আর্থিক ব্যবস্থা বদলের অন্যতম ফরজ ইবাদত যাকাত

আর্থিক ব্যবস্থা বদলের অন্যতম ফরজ ইবাদত যাকাত
আর্থিক ব্যবস্থা বদলের অন্যতম ফরজ ইবাদত যাকাত  © সংগৃহীত

ইসলামে যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে; ইসলামের মৌলিক ভিত্তি সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত যাকাত। যাকাত প্রদানের মধ্যমে সমাজের ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যহীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা সম্ভব। যাকাতের মাধ্যমে বান্দার সম্পদ পবিত্র হয়। এমনকি সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাই পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় সামর্থবানদের যাকাত প্রদানে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত প্রদান করো।’

যাকাত আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হলো, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। যাকাত মালকে পবিত্র করে এবং বিভিন্ন ক্ষতি ও কৃপণতা থেকে মানুষকে হেফাজত করে। যাকাত ইসলামের মৌলিক পাঁচ মধ্যে স্তম্ভের মধ্যে পঞ্চম। তাই নির্দিষ্ট পন্থায় কোন মাল (অর্থ) থেকে বিশেষ কোন পদ্ধতিতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যথাযথ পন্থায় ব্যয় করাই যাকাত। যাকাত অস্বীকারকারী কাফের।

যাকাতের ইতিহাস:
সৃষ্টির সূচনা থেকেই ইসলামে যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। কারণ মহান রব্বুল আলামীন যখন পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী হিসেবে তৈরি করেন, ঠিক সেই থেকে দুনিয়াতে ধনী ও দরিদ্র এ দুই শ্রেণির মানুষ বসবাস করে আসছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি তাদের পরীক্ষার জন্য যাকাত প্রদানে উৎসাহিত করেছেন। তাই যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যায়ে বিভিন্ন যুগে যাকাতের প্রদানের ইতিহাস সম্পর্কে জানবো:

ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদাভেদ দূর করে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠাই যাকাতের বিধান বিভিন্ন নবী-রাসুলের আমলে প্রচলিত ছিল। হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যুগে যাকাতের বিধান সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেন, 'আমি তাদের ইমাম/ নেতা বানিয়েছি। যাতে তারা তাঁর নির্দেশনা মতো আমার বিধান অনুযায়ী চলে এবং আমার জন্য ভালো ভালো কাজ স্বরূপ নামায কায়েম ও যাকাত প্রদান করত। বস্তুত তারাই ইবাদতকারী ছিল। হজরত ইসমাইল আ. সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, 'স্মরণ করুন, ইসমাইল আ. এর কিতাবের কথা। নিশ্চয়ই তিনি ওয়াদা সত্য প্রমাণকারী ছিল এবং তিনি নবি-রাসুল। তিনি তার জনগণকে নামাজ পড়ার ও যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিতেন। আর তিনি তাঁর আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় ও সন্তুষ্টি-প্রাপ্ত ছিলেন’।

বনী ইসরাইলদের যুগে যাকাতের চুক্তি বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর স্মরণ করুন আমরা যখন বনী ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবে না। পিতামাতার সাথে সদ্বব্যবহার করবে। নামায কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা আ. এর উপর যাকাত ও নামায সম্পর্কে অসিয়ত করে বলেন, 'আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন নামায ও যাকাত সম্পর্কে যদ্দিন আমি জীবিত থাকব।

পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মদ (স) এর উপর যাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনের আয়াতসমূহের প্রায় সকল অবস্থায়ই দারিদ্রদের দুঃখ মোচনের আহবান জানানো হয়েছে। আর যারা যাকাত দেয় না তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। তবে ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মুসলমানদের উপর যাকাত ফরয ছিলনা। যে ব্যক্তি যাকাত বা সদকাহ প্রদান করতো তাকে উৎসাহী করা হতো। কারণ সেই সময় যাকাত সম্বলিত আয়াত নাযিল হয়েছে। কিন্তু যাকাত ফরজ হওয়া আয়াত নাযিল হয় নাই। কিন্তু রাসুল সা. হিজরত করে মদিনায় চলে গেলে ইসলামের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট বিধান প্রয়োগ করেন।

এমনকি যাকাতের ক্ষেত্রেও মদিনায় আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) উপর অনেক আয়াত নাযিল করেছেন। কুরআন মাজিদে মোট ১৮টি সূরার ২৯ আয়াতে যাকাত শব্দটির ব্যবহার দেখা যায়। তন্মধ্যে ৯টি সুরা মাক্কী আর ৯টি মাদানী।

মদিনায় নাযিল কৃত আয়াতসমূহ মধ্যে সূরা আল হজ্জ হিজরতের প্রথম বছরই নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ যাকাতকে ফরজ করে ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন। যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে।’

যাকাতের বিধান:
যাকাত সকলের উপর ফরজ নয়। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক ও সম্পদশালী মুসলমানদের উপরই কেবল যাকাত ফরয। এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে-

১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।

২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরজ নয়।

৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ নয়।

৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরজ নয়।

৫. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।

৬. মাল বর্ধনশীল হওয়া।

৭. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরজ নয়।

৮. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরজ হয় না।

৯. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।

যাকাতের খাত:
নির্ধারিত খাতে যথাযথ ভাবে যাকাত প্রদান না করলে, তা আদায় হয় না। যাকাতের খাত নির্ধারণ স্বয়ং আল্লাহ করেছেন। সূরা তওবায় যাকাতের আটটি খাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘যাকাত তো সেসব লোকেরই জন্য, যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যারা তা সংগ্রহ করে আনে, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’

আয়াতের আলোকে আটটি খাতে যাকাত বন্টন করার কথা বলা হয়েছে; ১. ফকির (যার নিতান্ত সামান্য পাথেয় আছে), ২. মিসকিন (যার কিছুই নেই), ৩. যাকাত সংগ্রহের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি (তার পারিশ্রমিক অনুযায়ী), ৪. দ্বীন ইসলামের প্রতি চিত্তাকর্ষণে কোনো অমুসলিম কিংবা ইসলামে অটল রাখার্থে নও মুসলিম, ৫. দাসদাসীর মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭. একান্ত ও শরিয়ত সম্মত আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং ৮. রিক্তহস্ত মুসাফির।

যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত:
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। যেকোনো সময়ের থেকে রমজান মাসে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা এ সময় আল্লাহ বান্দার প্রত্যেকটি নেক আমলের সাওয়াব সত্তর গুণ বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ চাইলে এর সাওয়াব অগণিত হতে পারে। পবিত্র কুরআনে বহু জায়গায় নামাজের সাথে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূরা মুযাম্মিলে আল্লাহ বলেন: ‘আর তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর।

যাকাত ধনীদের দয়া বা অনুগ্রহ নয়। যাকাত গরিবের অধিকার। তাই যাকাত আদায় করা ধনীদের উপর ফরজ। সূরা আয যারিয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘তাদের অর্থাৎ ধনীদের ধন-সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।

যাকাত আদায়ের ব্যাপারে হুশিয়ার করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের সূরা তাওবায় বলেছেন, যারা সোনা রুপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং  তা দিয়ে কপালে, পাঁজরে এবং পিঠে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে  এ তো সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে। এখন সে সঞ্চিত সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর।

বুখারী শরীফে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন সে যদি ঐ সম্পদের যাকাত আদায় না করে, তাহলে তার সম্পদকে কিয়ামতের দিন টাকপড়া বিষধর সাপের রূপ দান করা হবে। যার চোখের উপর দুটি কালো দাগ থাকবে যা কিয়ামতের দিন তার গলায় বেড়ির মত পেঁচিয়ে দেয়া হবে। অতপর সে সাপটি তার চোয়ালে দংশন করে বলতে থাকবে আমিই তোমার সম্পদ,আমিই তোমার কুক্ষিগত মাল’।

তবে যাকাদত প্রদানকারীর সুসংবাদ দিয়ে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘নবী কারিম (সা.) বলেছেন, দান আল্লাহর ক্রোধ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে’।

মুসলিম শরীফে উল্লেখ হয়েছে, ‘রাসূল (স.) বলেন, সদকায় সম্পদ হ্রাস পায় না এবং ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ শুধু বান্দার সম্মানই বাড়িয়ে দেন আর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় অবলম্বনকারীকে আল্লাহ উপরে উঠিয়ে দেন’।

আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়কারীদের রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ নিয়ে থাকেন। সূরা সাবা’র ৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দান করবেন। আর তিনিই উত্তম রিজিকদাতা।’

তাই পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথাযথভাবে যাকাত আদায় করা জরুরি। একইভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের পাশাপাশি অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা। কারণ যাকাত আদায়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যহীন একটি সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব। যেখানে ধনী-গরীবের ভেদাভেদ থাকবে না।


সর্বশেষ সংবাদ