খাবার খাই, গান গাই, কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জিকে এড়িয়ে চলি
শুভ নববর্ষ। বলছি বটে শুভ নববর্ষ, ভাবছি বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে কি আমরা আদৌ সারা বছর চলি? চলি না। মনে আছে যখন ডাক্তারি পড়তাম, এবং ডাক্তারি করতাম, তখন রোগীদের সঙ্গে রোগ নিয়ে কথা বললে ওরা বাংলা মাসের হিসেব দিত, একটি উদাহরণ দিচ্ছি: ' জোষ্ঠি মাসে অল্প যন্ত্রণা ছিল পেটে, আষাঢ় মাসে পেটের ডানদিকে তীব্র যন্ত্রণা শুরু হইলো, শাওন মাসে কবিরাজ দেখাইলাম, কবিরাজি ওষুধ খাইলাম।
ভাদ্র মাসে যন্ত্রণা বাড়লো, আয়ুর্বেদী ওষুধ খাইলাম, আশ্বিন মাসে হোমিওপ্যাথি খাইলাম, কার্তিক মাসে পেটের বাম দিকেও যন্ত্রণা শুরু হইলো, ইউনানি ডাক্তার দেখাইলাম, অঘ্রান মাসে বমি শুরু হইলো, পৌষ মাসে হাত পায়ে কোনও শক্তি পাই নাই, মাঘ মাসে যন্ত্রণা পেট থেইকা বুকে গেল, ফাগুন মাসে বিছানা থেইকা উঠতে পারি না, চৈত্র মাসে খাওয়া বন্ধ হইয়া গেল, বৈশাখ মাসে এই আইলাম সরকারি হাসপাতালে।'
ডাক্তারদের তখন বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মিলিয়ে দেখে বুঝতে হতো রোগীর রোগের ইতিহাস। শুধু ওই সময়টাতেই আমার বা আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারের দরকার পড়তো, তাছাড়া পড়তো না।
আমি জানিনা এখনও গ্রামের মানুষ বাংলা মাসের হিসেবে জীবন যাপন করে কিনা। তবে আমরা শিক্ষিত শহুরেরা ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন করি, বাংলা খাবার খাই, বাংলা গান গাই, কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জিকে এড়িয়ে চলি। এখন আর আগের মতো দোকানপাটে হালখাতাও হয় না। দোকানিদের কাছেও হালখাতা বড় সেকেলে। কৃষকদেরও মনে হয় না বাংলা মাসের হিসেব রাখতে হয়। তারাও বেশ আধুনিক এখন।
গ্রাম বদলে যাচ্ছে। গ্রাম বদলে গেলে ফসল বোনা ফসল কাটা নবান্নের উৎসব কিছুতেই আর বাংলা বর্ষপঞ্জির দরকার হবে না। বাংলা মাসগুলো আমাদের স্মৃতিতে, নয়তো বাংলার ইতিহাসের পুস্তিকাতে ঠাঁই পাবে।
আর কত বছর নববর্ষের উৎসব হবে, মেলা হবে, গান কবিতা হবে, মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে, তা কেউ সঠিক বলতে পারবে না। তবু ধর্মীয় উৎসব ছাড়া বাঙালির তো তেমন কোনও উৎসব নেই, অন্তত নিছক উৎসবের জন্য হলেও নববর্ষের উৎসব আরও হাজার বছর ধরে হোক। তা না হলে বাঙালির কাঙালি হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।