ভারতে করোনা সুনামি ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য পূর্ব প্রস্তুতি

 মো. হাসান তারেক
মো. হাসান তারেক  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাসের অধিক সংক্রমণ ও মৃত্যুতে টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ভারতের হাসপাতালগুলোতে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে অক্সিজেন ও ঔষধের তীব্র সংকট। দিল্লি হাইকোর্ট এ কারণে ভারতের করোনা পরিস্থিতিকে “সুনামি” বলে আখ্যায়িত করেছে।

দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় ভারতে সংক্রমণের হার বেড়েছে। টানা তিন দিন ধরে করোনা সংক্রমণের রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে দেশটি। গত বৃহস্পতিবারের পূর্ব পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা রোগী শনাক্তের রেকর্ডটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। দেশটিতে গত জানুয়ারিতে একদিনে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৩০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার ভারত সে রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত হল ৩ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৫ রোগী। ভারতের করোনা পরিস্থিতির বেহাল দশার জন্য দায়ী করোনার নতুন দুইটি ধরন। এ দুটি হলো বি-১.৬১৭ এবং বি-১.৬১৮। ভারতের করোনার নাজুক পরিস্থিতিতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সৌদি আরব।

ভারতে যখন করোনা সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি চলমান ঠিক সে সময় ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশেও করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে বাংলাদেশে। চলতি এপ্রিল মাসে দৈনিক সংক্রমণ সাত হাজারের সীমা অতিক্রম করে। মৃত্যু পেরিয়েছে শতক। বিগত ১৩ মাসের মধ্যে যা কার্যত উর্ধ্বমুখী। করোনা সংক্রমণের এই উর্ধ্বমুখীতাকে বাংলাদেশে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়।

এই পরিস্থিতিতে করোনার উর্ধ্বগামিতার রাশ টেনে ধরার জন্য সরকার বিভিন্ন মেয়াদি লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। জীবন ও জীবিকার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সরকারি উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। প্রবল শক্তিশালী করোনার ভারতীয় ধরন যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ইতিমধ্যেই পার্শ্ববর্তী এই রাষ্ট্রের সঙ্গে সীমান্ত যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে ১৪ দিনের জন্য। শুধু পণ্য সরবরাহ চালু রাখা হয়েছে। সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরলসভাবে যাতে পরিস্থিতি নাজুক না হয়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও ব্যক্তি পর্যায় থেকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে, নতুবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন।

এক্ষেত্রে আমরা ভারতের কেরালা রাজ্যর উদাহরণ টানতেই পারি। করোনার প্রথম ঢেউ এবং বর্তমান দ্বিতীয় ঢেউয়েও ভারতকে পথ দেখাচ্ছে কেরালা। এটি সম্ভব হয়েছে রাজ্য সরকারের উদ্যোগের সাথে জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততার কারণে। অবিজেপি শাসিত কেরালায় ভ্যাকসিন বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য গণচাঁদা সংগ্রহের নজিরও দেখা যায়। সেখানে বাংলাদেশে লকডাউন ভেঙে বেরিয়ে পরার চিত্র হরহামেশায় দেখা যাচ্ছে। এখানে নিজ থেকে নিয়ম মানার আগ্রহ মানুষের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে, সরকারি উদ্যোগগুলোকে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত করতে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। আমাদের জীবন রক্ষার্থে আমরা ব্যক্তি পর্যায় থেকে উদ্যোগী না হলে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ।

এখন আসা যাক মোদ্দা কথায়। ভারতের এই করোনা সুনামির কারণে বাংলাদেশের আসন্ন পরিস্থিতি নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। একারণে আসন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের কিছু উদ্যোগ নেওয়া অতীব জরুরি।

প্রথমত, সকলের জন্য ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। করোনার মত অতি মহামারির গতি শ্লথ করার কার্যকর অস্ত্র হচ্ছে ভ্যাকসিন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে এই বছরের ২৭ জানুয়ারি কুর্মিটোলা হাসপাতালে একজন নার্সকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচী উদ্বোধন হয়। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতে করোনার ঊর্ধ্বগতির কারণে ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ অন্যান্য বিকল্প উৎসগুলো থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভ্যাকসিন নিশ্চিতের জন্য ইতিমধ্যে চীন, রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও চুক্তি হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে, দ্যা ল্যানসেট ও দ্যা জার্নাল অব দ্যা আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় করোনার বিপক্ষে বেশ কার্যকর চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন। ইতিমধ্যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর, জর্ডান, সার্বিয়া, মরক্কো, হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন দেশে চীনের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য,আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার ভ্যাকসিন স্পুটনিক-ভির প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও অনুমতি মিলেছে রাশিয়ার ভ্যাকসিন প্রয়োগের। অতি দ্রুত এসব উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে, সকলের জন্য বণ্টন সুনিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের মত ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্সিজেনের মজুদ বৃদ্ধি ও সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। গত ছয় সপ্তাহে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। দেশে পাঁচটি অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। একারণে ভারত থেকে অক্সিজেন আনতে হয়। কিন্তু ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ভারত অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আসন্ন সংকট মোকাবিলায় সরকার সিঙ্গাপুরসহ বিকল্প উৎসগুলো নিয়ে ভাবনা- চিন্তা করছে। তাছাড়া শিল্পখাতে ইতিমধ্যে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এগুলোর পাশাপাশি সরকারের অক্সিজেন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন প্লান্ট তৈরির জন্য উদ্যোগী হতে হবে।

তৃতীয়ত, করোনার ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য করোনার টেস্ট বৃদ্ধির পাশাপাশি মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণ উৎসাহিত করা সঙ্গে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।

চতুর্থত, বাংলাদেশের মত দেশে করোনার মত মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনের বলিষ্ঠ উদ্যোগ হতে পারে সবচেয়ে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ।

পঞ্চমত, করোনা মোকাবিলায় যে উদ্যোগগুলো নেয়া হবে তা কার্যকরভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে কি না তা তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে।

সর্বোপরি, রাষ্ট্র ও সরকারের পাশাপাশি জনগণের ইতিবাচক মানসিকতা, জন-সম্পৃক্তার মাধ্যমে করোনার মত মহামারির মোকাবিলা করা যেতে পারে।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।


সর্বশেষ সংবাদ