করোনা থেকে আরোগ্যলাভকারীর পুনঃসংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা যাচাই

  © টিডিসি ফটো

যখন বহিরাগত আক্রমণকারী যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে প্রবেশ করে, দেহের লিম্ফোসাইটস নামক ইমিউন কোষগুলো এন্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সাড়া দেয়। এন্টিবডি হচ্ছে প্রোটিন। এই এন্টিবডিগুলো বহিরাগত আক্রমণকারীর (এন্টিজেন) সাথে লড়াই করে এবং দেহকে অতিরিক্ত সংক্রমণের থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, একজন সুস্থ মানুষ এন্টিজেন দ্বারা আক্রান্তের সময় প্রতি দিনে দশ লক্ষ এন্ডিবডি তৈরি করতে পারে এবং এন্টিজেনের সাথে কার্যকরভাবে লড়াই করে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মানুষের দেহ যখন প্রথম কোন বিশেষ ধরণের এন্টিজেন দ্বারা আক্রান্ত হয়, তা মোকাবিলায় দেহের এন্টিবডিগুলোর সক্রিয় সাড়া দিতে কয়েকদিন সময় লাগে (সূত্রঃ যুক্তরাস্ট্রের জীব বিজ্ঞান সম্পর্কিত অনলাইন সাইট লাইফসায়েন্স)। এই সময়ে সংক্রমণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং মাঝে মাঝে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতির পূর্বে তীব্র সংক্রমণে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের চিলড্রেন হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়া ভ্যাকসিন এডুকেশন সেন্টার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মৃত বা দুর্বল এন্টিজেন (ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা ভ্যাকসিন তৈরি হয়। তারা (ভ্যাকসিন) মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে না, কিন্তু মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তাদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করে এবং দেহ লড়াইয়ের জন্য এন্টিবডি উৎপন্ন করে। বিপদ আশংকা কেটে গেলে অনেক এন্টিবডি ভেঙ্গে যায়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ইমিউন কোষগুলি (যাকে মেমোরি কোষ বলা হয়) দেহে থেকে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টাইম নিউজ পেপার প্রদত্ত তথ্য মতে, চীনের দক্ষিণ-পূর্বভাগের শেনচেন শহরে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জড আরোগ্যলাভকারী ২৬২ জনের মধ্যে ৩৮ জনের দেহে (অর্থাৎ মোট আরোগ্যলাভকারীর প্রায় ১৫%) পরবর্তীতে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস SARS-CoV-2 সনাক্ত হয়েছিল। উল্লেখিত ৩৮ জনের সকলেই কোভিড-১৯ রোগের লক্ষণবিহীন (asymptomatic) ছিলেন। চীনের উহান শহরে (যেখানে বৈশ্বিক মহামারি আরম্ভ হয়েছিল) টেস্ট করে আরোগ্যলাভকারী চারজন স্বাস্থ্য কর্মীর দেহে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সনাক্ত হয়েছিল। একইভাবে, শেনচেন শহরের স্ট্যাডির মত তারাও লক্ষণবিহীন (asymptomatic) ছিলেন। তাদের পরিবারের সদস্যরা সংক্রমিত হয় নাই। জাপান ও দক্ষিন কোরিয়ায় কিছু রোগী কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে আরোগ্য লাভের পর পুনরায় করোনাভাইরাস পজিটিভ টেস্টের কারণে হাসপাতালে পুনঃভর্তি হয়েছিলেন।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, ‘কোভিড-১৯ এর মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ রেসপন্স/সাড়া এখন পর্যন্ত অজানা।’ সিডিসি ব্যাখ্যা করেন, Middle East respiratory syndrome-CoV/MERS-CoV সংক্রমণ আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তিকে শীগগির পুনঃসংক্রমিত করে নাই, কিন্তু কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে একই রোগ প্রতিরোধ সুরক্ষা (immune protection) দেখা যাবে কিনা তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। সিডিসির জাতীয় টিকা এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগ কেন্দ্রের পরিচালক ড. ন্যান্সি মেসোনিনার বলেন, যেহেতু কোভিড-১৯ খুব নতুন, জনগোষ্ঠীর দেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে‍ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নাই।

যে কোন ভাইরাস, এমনকি করোনাভাইরাস পরিবারের মানুষের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্ন ভাইরাসের ক্ষেত্রেও, সংক্রমণের সময়কালে মানুষের দেহ সুনির্দিস্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্ডিবডি নামক প্রোটিন তৈরি করে যা সুনির্দিস্ট ভাইরাসের জন্য মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখে। কিন্তু এখন পর্যন্ত গবেষকগণ কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর সঙ্গে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার সম্পর্কের সত্যতা ও ধরণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন (সূত্রঃ যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক টাইম নিউজ পেপার)।

কিছু গবেষক বিশ্বাস করছেন, এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত থেকে আরোগ্যলাভকারী মানুষের দেহে উক্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে না উঠলে, আক্রান্ত একই দেশগুলোতে বারবার আঘাত হেনে বিশ্বে তাণ্ডব চালিয়ে যাবে। এ বিষয়ে অনেক অনিশ্চয়তা থাকার পরও, কিছু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার আরোগ্য লাভ করে আবার আক্রান্ত হওয়াটা পুনঃসংক্রমণ নয়; এটি প্রথমবার আক্রান্তের সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হওয়া যা ঐ সময়কালে ডায়াগনস্টিক টেস্টে সঠিকভাবে সনাক্ত করতে ব্যর্থতা ছিল।

স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ গণের মতে, ভাইরাস আক্রমণের পরে মানুষের দেহে এন্ডিবডি তৈরিতে ট্রিগার করে, যার অর্থ-মানুষ কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্য লাভের পর শিগগিরই ভাইরাসের সংস্পর্শে পুনঃসংক্রমিত হবে না। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস মেডিক্যাল ব্রাঞ্চের ভাইরোলোজিস্ট ড. ভিনেট মেনাচেরি বলেন, মানুষের দেহে ভাইরাস প্রথম আক্রমণের সময় থেকে সচরাচর ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এন্টিবডি তৈরি হয়। কোভিড-১৯ রোগী আরোগ্য লাভের পর ডায়াগনস্টিক টেস্টে ভাইরাসের উপস্থিতি না পেয়ে পুনঃআক্রান্ত হলে, ডায়াগনস্টিক টেস্ট ভ্রান্ত নেগেটিভ ছিল এবং রোগী অনবরত সংক্রমিত ছিল। চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অফ হংকং এর রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডেভিড হুই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এটি টেস্টের জন্য গৃহীত নমুনা/স্পেসিমেন (specimen) এর গুণগত মানের জন্য হতে পারে এবং হতে পারে টেস্টটি সুক্ষ/সংবেদনশীল (sensitive) ছিল না।

উল্লেখ্য যে, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডেভিড হুই ২০০২-২০০৩ সালে সংগঠিত মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome-CoV) বিশেষজ্ঞ। কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV-2 ও পূর্বের SARS-CoV উভয়েই একই করোনাভাইরাস পরিবারের সদস্য।

এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। RNA অর্থ Ribonucleic acid (রাইবোনিউক্লিক এসিড)। মানুষের রোগের জন্য দায়ী সাতটি করোনাভাইরাগুলোর মধ্যে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ হচ্ছে সপ্তম প্রজাতি। কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির দেহে থেকে যাওয়া কিছু অবশিষ্ট ভাইরাল RNA সনাক্তের মাধ্যমে পজিটিভ টেস্ট পাওয়া গেলেও, তা রোগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস মেডিক্যাল ব্রাঞ্চের ভাইরোলোজিস্ট ড. ভিনেট মেনাচেরি বলেন, ‘ভাইরাল RNA দেহে দীর্ঘ দিন স্থায়ী হতে পারে এমনকি প্রকৃত ভাইরাস স্তব্ধ হওয়ার পরেও।’

ইমারজিং ইংফেক্সাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ সালে সংগঠিত মহামারির জন্য দায়ী করোনাভাইরাস SARS-CoV এর সংক্রমণের ফলে মানবদেহে গঠিত নির্দিষ্ট এন্ডিবডি উক্ত ভাইরাসের ক্ষেত্রে গড়ে দুই বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রেখেছিল এবং তৃতীয় বছরে উক্ত নির্দিষ্ট এন্ডিবডিগুলির (Immunoglobulin G বা IgG) উল্লেখ্যযোগ্য হ্রাস ঘটেছিল। সেকারণে SARS-CoV দ্বারা প্রথম সংক্রমণের পর তৃতীয় বছরে বা তারপরেও ইতোপূর্বে আক্রান্ত ব্যক্তির পুনঃসংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডেভিড হুই উল্লেখ করেন, MERS-CoV (করোনাভাইরাস পরিবারের অন্য একটি প্রজাতি) থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির দেহে গঠিত নির্দিষ্ট এন্ডিবডি প্রায় এক বছর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্য হাফিংটন পোষ্ট নিউজপেপারে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস মেডিক্যাল স্কুলের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ড. পিটার জাং বলেন, ‘কেউ নিশ্চিত তথ্য জানে না কিন্তু অধিকাংশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুর দেহে অন্তত স্বল্প মেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠে।’ বেইজিং এর চায়না জাপান ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালের নিউমোনিয়া প্রিভেনশন এন্ড ট্রিটমেন্টের ডাইরেক্টর লি এর ভাষ্যমতে, যারা কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তাঁদের দেহে রোগ প্রতিরোধী এন্ডিবডি উদ্দীপিত হয় (সূত্রঃ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক নিউজ পেপার ইনডিপেন্ডেন্ট)। অন্যান্ন করোনাভাইরাসের এন্টিবডির সম্পর্কে জ্ঞাত তথ্য বিবেচনা করে ভাইরোলোজিস্ট ড. ভিনেট মেনাচেরি প্রাক্কলন করেন, কোভিড-১৯ স্পেসিফিক এন্টিবডি দুই থেকে তিন বছর আরোগ্যলাভকারীর ব্যক্তির দৈহিক তন্ত্রে থাকবে। তবে তিনি বলেন, নিশ্চিত হতে আরোও সময় প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের পেন মেডিসিনের চিকিৎসক ও পেন গ্লোবাল মেডিসিনের মেডিক্যাল ডাইরেক্টর ড স্টিফেন গ্লাকম্যান বলেছেন, এটি (কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) মনে হয় অধিকাংশ আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে অন্যান্ন করোনাভাইরাস জনিত রোগের ফলে সৃষ্ট ইমিউনিটির (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) অনুরুপ হবে।

ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড-১৯ রোগ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির দ্রুত পুনঃসংক্রমণের সম্ভাবনা কম। বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ, আক্রান্ত ও আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তিকে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এর পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি পন্থাগুলো (আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকা, ঘন ঘন সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিস্কার করা এবং মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার হাঁচি/কাশি/থুতুর তরল ড্রপলেট নিয়ন্ত্রণ করা) মেনে চলার সুপারিশ করেছেন। নতুন করোনাভাইরাস দ্বারা কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্যলাভকারী ব্যক্তির পুনঃসংক্রমণের সম্ভব কি না তা নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা প্রয়োজন কারণ কার্যকর ভ্যাকসিন আবিস্কারে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকিন্তু, সুস্থ হওয়া কোভিড-১৯ রোগীর রক্তের স্ট্রং ইমিউন রেসপন্স (শক্তিশালি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) প্লাজমা দিয়েই করোনা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রক্তের লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও প্লাটিলেটস সরিয়ে ফেলার পর যে ঈষৎ হলুদ রঙয়ের স্বচ্ছ তরল পদার্থ পাওয়া যায়, তাকে ‘প্লাজমা’ বলে। ‘প্লাজমা’ এন্ডিবডি ধারণ করে।

লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: drmaasgar@gmail.com 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence