ভাষা আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক ভিত গড়ে দিয়েছিলেন যারা

  © ফাইল ফটো

মাতৃভাষায় যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়া কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সার্বিক বিকাশ ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি ভৌগলিক অবস্থানে নির্দিষ্ট একটি ভাষার বেড়ে উঠা ঐ স্থানের মানুষের মানস বিন্যাস-গঠন এবং ঐক্যের ভিত গড়ে দেয়। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত এ অঞ্চলে তেমনি বেড়ে উঠে প্রাণের ভাষা, বাংলাভাষা। নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখের বুলি হিসেবে এ ভাষা অসামান্য প্রাধান্য পায়। তাই ভাষার উপর দাড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় এবং প্রাত্যহিক জীবন যাপন করা সহজ হয়ে উঠে বাংলাভাষীদের জন্য।

কিন্তু পরদেশীদের শাসন বদলে দেয় তাদের প্রশাসনিক ভাষা। যোগাযোগ মাধ্যমে এ অসঙ্গতি পিছনে ঠেলে দেয় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে। ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য তাই বিশিষ্ট বাঙালিদের আবেদন-যুক্তি-দাবি উচ্চারিত হতে থাকে ভাষা আন্দোলনের অনেক আগে থেকে। ভাষা আন্দোলনে এ আবেদন-দাবিই মনস্তাত্ত্বিক শক্তি যুগিয়েছিল বলে মনে করেন ভাষা সৈনিক ও বিজ্ঞজনরা।

বিস্ময়করভাবে সত্যি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত দেন ব্রিটিশ লেখক নাথানিয়েল ব্রাসি হলহেড। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত তার বই ‘এ গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (হলহেডের ব্যাকরণ নামে পরিচিত) বইয়ের ভূমিকায় তিনি এ অঞ্চলের সরকারি কাজ-কর্মে ফার্সির পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের সুবিধা তুলে ধরেন। এজন্য তিনি বাংলাকে সরকারি কাজের ভাষা বা ‘রাষ্ট্রের ভাষা’ করার প্রস্তাব করেন।

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী’ (কলকাতা-১৯৬৮) থেকে জানা যায়, ভারত স্বাধীনতার আগে ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্ব-ভারতীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা (লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা) হিসেবে হিন্দীর পক্ষে মত দেন।

রবীন্দ্রনাথের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সভায় অংশগ্রহণকারী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাধারণ ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি জানান। ১৯৩৭ সালের ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলাভাষা ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলাভাষায় বিবিধ ভাব প্রকাশোপযোগী শব্দের সংখ্যাও বেশী। অতএব বাংলা সবদিক দিয়েই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি করতে পারে।”

১৯৪৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব দেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম। প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে দেয়া খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বাংলাকে পূর্ব-বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ২৭ জুন প্রকাশিত ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা ভাষাই হইবে ইহা বলাই বাহুল্য।” আবুল মনসুর আহমদ তখন এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

একই বছরের ৩০ জুন দৈনিক আজাদে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আবদুল হক বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন।

১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কামরুদ্দিন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিনসহ মুসলিম লীগের কয়েকজন প্রগতিশীল নেতা গণআজাদী লীগ গঠন করেন। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের দিন ৫ জুলাই এর ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়, “বাংলা হইবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। ৩০ জুলাই দৈনিক আজাদে মাহবুব জামাল জাহেদী ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে একই মত প্রকাশ করেন।

এ বছরই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর দাবি করলেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিরোধিতা করেন। ২৯ জুলাই প্রকাশিত দৈনিক আজাদে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেন, “এটা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের বিগর্হিতও বটে।”

এভাবেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অনেক আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিভিন্নজনের মত-দাবি উঠে আসে। এ সময় কেউ প্রত্যক্ষ আন্দোলন গড়ে না তুললেও তাদের মত-দাবিগুলোই পরবর্তীতে আন্দোলনের সাফল্যের মনস্তাত্ত্বিক ভিত গড়ে তুলে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence