প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকগণ ১১তম গ্রেড বাস্তবায়নের অপেক্ষায়

ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল প্রধান হাতিয়ার। সাহিত্য ও সংস্কৃতির শক্তিকে বুকে ধারণ করে পরাধীন ভারতীয় জনগণ সেদিন ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছিল। যেসব সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ সেদিন হয়ে উঠেছিলেন একেকজন বিপ্লবী তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কালজয়ী রম্য লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তাঁর রচিত ‘পাদটিকা’ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে ব্রিটিশ আমলের একজন শিক্ষকের দরিদ্রতার করুণ চিত্র- পণ্ডিতমশাই ক্ষোভে, দুঃখে হুংকার করে। সহজ অথচ পৃথিবীর কঠিনতম গাণিতিক সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন ছাত্রদের কাছে। ছাত্ররা লজ্জায় অবনত শিরে বসেছিল সেদিন। পণ্ডিত মশাইয়ের শত শত ছাত্র লেখাপড়া শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশদের তাড়িয়েছে, কিন্তু ভুলে গেছে পণ্ডিত মশাইয়ের ছোট গাণিতিক সমস্যার সমাধান দেয়ার কথা।

২.
ব্রিটেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনোমিক এবং সোশ্যাল রিসার্চ এর এক গবেষণায় ‘শিক্ষকের মর্যাদা সূচক’ প্রকাশ করেছে, তাতে চীন তালিকার সবচেয়ে ওপরে। চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। এশিয়ার অন্যান্য দেশ বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। এতে করে চীনের কি দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির কাজ সহজ হয়নি?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে মালয়েশিয়ার লোকজন আমাদের দেশে কাজ করতে আসতো আর আজ তারা কতদূর এগিয়েছে- প্রশ্নটা আপনাদের কাছে? এর পেছনে রয়েছে শিক্ষক তথা শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। চোখ বন্ধ করে একবার ভেবে বলুন তো এদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কতটুকু মর্যাদা দেওয়া হয়? বিস্ময়কর হলেও সত্য, বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দের হার জিডিপির দুই শতাংশেরও কম, যেখানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় এ হার চারেরও বেশি৷ উন্নত বিশ্বের কথা না-ই বা তুললাম।

৩.
সময়টা প্রচারের, মিডিয়ার। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ অন্যান্য মিডিয়া শিক্ষকের মর্যাদা, শিক্ষকের বঞ্চনার করুণ ইতিহাস যদি যথাযথভাবে ফুটিয়ে না তোলে, তবে শুধু শিক্ষক নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংস ত্বরান্বিত হবে। দেশের উন্নতি নির্ভর করে যে শিক্ষার ওপর- তার প্রথম ধাপ হচ্ছে প্রাথমিক স্তর। ভিত যদি দুর্বল হয়, তাহলে বাদবাকি শিক্ষাও নড়বড়ে হতে বাধ্য।

শিক্ষক একজন শিল্পী। তিনি প্রতিনিয়ত শিষ্যের মাঝে সৃষ্টির আনন্দ, বেঁচে থাকার পথ খোঁজেন। শিক্ষকই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মা-বাবার পরে তাঁর চেয়েও অসীম উঁচুতে তাঁর সৃষ্টিকে দেখতে চান। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবি ঠাকুরের ‘ব্যবধান’ গল্পের সেই উক্তি মনে পড়ে যায়-
‘হৃদয়ের সর্বপ্রথম স্নেহরস দিয়া যাহাকে মানুষ করা গিয়াছে, বয়সকালে যদি সে বুদ্ধি জ্ঞান এবং উন্নত স্বভাবের জন্য শ্রদ্ধার অধিকারী হয়, তবে তাহার মতো এমন পরমপ্রিয় বস্তু পৃথিবীতে আর পাওয়া যায় না।’

দেশের মিডিয়া জগতে যারা আছেন, সবারই পা পড়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায়। যাদের কলম সময়কে বদলে দেয়, বঞ্চিতকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়, শোষণের বিরুদ্ধে যারা ঝলসে ওঠেন, যাদের ক্যামেরা মানুষের দুঃখের-বঞ্চনার গল্প বলে, যারা নীতিনির্ধারণে এবং তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে অনুঘটকের কাজ করছেন, প্রত্যেকের ঋণ শোধের সময় এসেছে। শৈশবের অ, আ, ক, খ শেখানো শিক্ষাগুরু, যিঁনি একটু একটু করে গড়েছেন শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোপান, তাঁর মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসার সময় এখনই।

২৩ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশনের প্রস্তুতি নিয়ে সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা একত্রিত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লড়াইটা যতটা না ছিল অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি নৈতিক। শিক্ষক শব্দটার সঙ্গে সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ, উন্নত জীবনমান প্রভৃতি শব্দ চলে আসে। শিক্ষককে শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত করার দায় তাঁর ছাত্রদেরই নিতে হবে। তাদের এখন অবতীর্ণ হতে হবে ‘একলব্য’র ভূমিকায়। শিক্ষকরা শহীদ মিনার ছাড়লেও গুরুদক্ষিণার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। একলব্য! তুমি কি শুনতে পাচ্ছো গুরুর দীর্ঘশ্বাস?

৪.
প্রাথমিক শিক্ষার বৈষম্যের জালে পঁচন ধরে গেছে। অতি দ্রুতই সুতা ছেঁড়ায় শব্দ শোনা যাবে। আমাদের ভাই-বোনেরা ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই লড়াই শুরু করেছেন। সুতরাং ১১তম গ্রেড বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত অলস বসে থাকার সময় নেই। অতি ভদ্রতা দেখিয়ে বসে থেকে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হওয়ার সময়ও নেই। আপনাদের কাছে প্রশ্ন, ‘জীবন কি এতই প্রিয় আর শান্তি কি এতই মধুর যে, বৈষম্য আর দাসত্বের দামে তাকে কিনতে হবে?’ এ প্রশ্নের উত্তরে, ‘আমি জানি না অন্যরা কোন পথ বেছে নেবে। কিন্তু আমি প্যাট্রিক হেনরির মত বলব—‘আমাকে বৈষম্য থেকে মুক্তি ও মর্যাদা দাও, নয়তো মৃত্যু।’

যথাযথ কর্তৃপক্ষের শুভদৃষ্টি উদয়ের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের ১০ম ও সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের দ্রুত বাস্তবায়ন হোক।

লেখক: শিক্ষক


সর্বশেষ সংবাদ