সন্‌জীদা খাতুনের শেষ বিদায়ের আয়োজন নিয়ে বিতর্ক কেন?

মোজাফ্ফর হোসেন
মোজাফ্ফর হোসেন  © টিডিসি সম্পাদিত

যে সমাজের প্রায় অধিকাংশ মানুষ পরকাল নিয়ে উদ্বিগ্ন সেই সমাজে ঘুষ-দুর্নীতি, ঠকবাজি, অপরাজনীতি, লোকঠকানো, মিথ্যাচার এই অপরাধগুলো করে কারা আমি বুঝে পাই না। গত পঞ্চাশ বছর ধরে তো এই দেশ করাপশন ও ক্রাইমে সেরা দশের মধ্যেই আছে, নাকি? তার মানে কেউ নিজের দিকে খেয়াল করছে না। অন্যকে জান্নাতে নেয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত। সন্‌জীদা খাতুন জন্ম থেকে আমৃত্যু সংগীত ও সংস্কৃতি সাধনা করেছেন। তিনি নিজে সংগীতশিল্পী, সংগীতশিল্পের উদ্যোক্তা ও সংগঠক, শিল্পের সাধক। ট্রেডিশনাল অর্থে না বললে, সংগীত তার ধ্যান ও ধর্ম ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত জান্নাত নিয়ে তিনি কনসার্ন নাও থাকতে পারেন। তিনি মূর্খ না, রীতিমতো স্কলার মানুষ, পিতা শুধু শিক্ষা ও সংস্কৃতির না, ধর্মীয়ভাবেও পণ্ডিত, অতিএব যা করেছেন সব জেনে বুঝেই করেছেন। 

সন্‌জীদা  খাতুন তো কখনো নিজের ধর্মচর্চা নিয়ে কোনো কথা বলেননি। অন্যের ধর্মচর্চা নিয়েও বলতে যাননি। শেষ বিদায়ের যে আয়োজন সেটিও হয়েছে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, তাঁর গুণমুগ্ধরাই করেছেন। তাঁকে নিয়ে এতো টানাটানি কেন আপনাদের? আপনাদের কোনো বিষয়ে তো সন্‌জীদা খাতুন কখনো কিছু বলতে যাননি। একজনকে নিয়ে আপনাদের কোটি মানুষের এতো 'ইনসিকিউরিটি (উদ্বেগ অর্থে)' কেন?

আমাদের সমাজে দুয়েকজন মানুষ থাকবেন যারা শিল্পের জন্য, সর্বমানবিক ও মাঙ্গলিক সংস্কৃতি সাধনায় জীবন উৎসর্গ করবেন—এতে যে জান্নাতি হবেন না সেটি জেনেও। এঁদের সংখ্যা এখন কোটির বিপরীতে হাতে গোনা দুয়েকজন হবে হয়ত। ১৭ কোটি মানুষের দেশে এরকম দশটা লোক যদি থাকে, তাতে আপনাদের ভয় পাওয়ার বা উদ্বেগের তো কিছু নাই! যে নিরানব্বই ভাগ মুসলিম জান্নাত সাধনা করেন, অথচ জান্নাতে যাওয়ার মতো আখলাক ধারণ করেন, তাদের সমালোচনা করেন। সবার আগে নিজের আমলনামা ঠিক আছে কিনা সেইটা সুনিশ্চিত হন।

সন্‌জীদা খাতুন সেই সৎ মানুষ যিনি নিজের সাধনার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করেননি। সকালে সিনেমার শুটিং বিকালে ওয়াজ, গানের টাকা হারাম বলে সেটা দিয়ে বাজার না করে ঘর বানানো, আইটেম সংয়ে নেচে এসে হিজাব প্রচার করা—ইত্যাদি দ্বিচারিতামূলক নোংরামি করেননি তিনি। হ্যাঁ, যা মনে হচ্ছে, সেটা করলে বরঞ্চ আপনারা খুশি হতেন। ভণ্ড সমাজ ভণ্ডদেরই পছন্দ করে। সরি, তিনি ভণ্ড ছিলেন না, সমস্ত ভণ্ডামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলেন একা, সুর ও সংগীতকে অবলম্বন করে। 

সন্‌জীদা খাতুনকে নিয়ে আপনাদের অস্থির হওয়ার কিছু নাই। আপনাদের তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে না, নিশ্চিত থাকেন। সে দায় তিনি আপনার উপর দিয়ে যাননি। তিনি সংগীত নিয়ে ছিলেন, সমাজের কোনো ক্ষতি তাঁর দ্বারা হয়নি। ধর্ম নিয়ে থেকেও এই সমাজটা যারা জাহেলিয়াত বানিয়ে দিচ্ছে, তাদের ধরেন। যারা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে তাদের ধরেন। অবশ্য আপনি ধরার কে? আপনি কি অথরিটি? মোরাল পুলিশিং করার জন্য আপনি নিজে কি যথেষ্ট মোরালিস্ট? হলেও কিন্তু কাউকে উত্ত্যক্ত বা টিজ করার রাইট নাই। সেই রাইট আপনাকে রাষ্ট্র দেয়নি, যতদূর জানি আল্লাহও দেননি।

মুসলমান ভাইসকল, ১৮ কোটি মানুষের দেশে দুয়েকজন জাহান্নামি থাকতে পারে (প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থেকে), উদ্বিগ্ন হয়েন না, কিন্তু আপনি সেই দলে আছেন কিনা নিজের ভেতর ডুব দিয়ে দেখেন, অন্যের ভেতর ডুব দিয়ে পড়ে থাকলে তো হবে না, ভাই। কবরে অন্যের পাপপূন্যের হিসাব কিন্তু আপনার কাছে চাওয়া হবে না। এইভাবে কারো পেছনে লাগলে সওয়াব হয় বলেও জানা নেই। সওয়াব পাওয়া কঠিন কিছু না, তাই বলে ইতরামি করে হবে না।

সন্‌জীদা খাতুন মানুষটার দিকে তাকান, আপনাদের মতো পরকাল নিয়ে উদ্বিগ্ন না থেকেও, পরকালে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা না করেও, তিনি আমৃত্যু সততার সঙ্গে জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি নিজের সংগীতচর্চা ও স্বদেশের প্রতি সৎ ছিলেন। তিনি কোনো (অপ)ক্ষমতার রাজনীতি করেননি, ঘুষ দুর্নীতির বাণিজ্য করেননি, মানুষের কুৎসা রটাননি, অন্যের বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষ করেননি, অন্যের জীবন দুর্বিষহ করে তোলেননি। আপনি তো পরকাল নিয়ে চিন্তিত, আপনি এসবের কিছু করছেন না তো?

এবার আসি আপনার প্রশ্নে: সন্‌জীদা খাতুন কে? হিন্দু না মুসলিম? তিনি হিন্দু না মুসলমান, আমার জানার বিষয় না। আমার কারো ধর্মীয় বিশ্বাস জানার আগ্রহও নেই। ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে তিনি প্রখ্যাত হননি। তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। একাধারে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে শত বাধার মুখে রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্‌যাপন, ছায়ানট প্রতিষ্ঠা, বটমূলের বর্ষবরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভাষা-আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী দেশগঠনে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এই সব কারণে অবশ্য এমনিতেই আপনাদের তাঁকে পছন্দ হওয়ার কথা না! ভুল বলেছি কি? আসল কথা তাহলে সেটাই, নাকি?
সনজীদা খাতুন প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ, নজরুলের বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা। কাজী মোতাহার হোসেন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। একদম দাঁড়ি-টুপিসহ। কিন্তু ছেলেমেয়েদের তিনি তাঁর নিজের পথে চালিত করতে বাধ্য করেননি। সনজীদা খাতুনের ভাই কাজী আনোয়ার হোসেন সেবা প্রকাশনীর মাধ্যমে যে প্রজন্ম সৃষ্টি করেছেন, তার প্রভাব হাজার বছরেও ফুরাবার নয়। তিন বোন সনজীদা, ফাহমিদা, মাহমুদা নজরুল ও রবীন্দ্র সংগীতেই জীবন পার করেছেন। এতে কাজী মোতাহার হোসেনের সমস্যা হয়নি। কেয়ামতে জবাব দিতে হলে তিনি দেবেন, আপনি কে ভাই?? আপনাকে তাবৎ মুসলিম উম্মার দায় নিতে হবে না, নিজের ও নিজের পরিবারেরটা নেন।

টীকা হিসেবে বলি, সন্‌জীদা থাতুন কোনো দলীয় রাজনীতির পারপস সার্ভ করেননি। তার মতো মেরুদণ্ডযুক্ত মানুষ আমাদের দেশে দুটো পাওয়া মুশকিল। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকার ও বিএনপি সরকারের মধ্যবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাঁকে সংগীতে একুশে পদক দিয়েছিল। স্বাধীনতা পুরস্কার অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি হলেও আওয়ামী লীগ কিন্তু গত ১৫ বছরে দেয়নি। তিনি নিজেও এ ব্যাপারে উদ্যোগী হননি। মিডিয়া, কথিত জনপ্রিয়তা প্রত্যাখান করেছেন। নিভৃতে নিজের কাজটি করে গেছেন অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আপনারা তেমনটা করতে পারলে দেশটা বদলে যেত, আপনার জান্নাত প্রাপ্তিতেও সুবিধা হতো নির্দ্বিধায় বলা যায়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ