ঘরে বসে মোবাইলেই দেয়া যাবে নিয়োগ ও পাবলিক পরীক্ষা: সময়ের দাবি ও সম্ভাবনা

মো সাব্বির হোসেন
মো সাব্বির হোসেন   © টিডিসি সম্পাদিত

শিক্ষা জাতিয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি। যুগের পরিবর্তনের সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নও জরুরি হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে, তবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতি এখনো অনেকাংশে পেছনে রয়ে গেছে। প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি এখনও কাগজ-কলম নির্ভর, যেখানে পরীক্ষা নেওয়া, প্রশ্নপত্র তৈরি, খাতা পরিবহন ও মূল্যায়ন করতে প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় হয়। এতে যেমন শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়ে, তেমনি প্রশাসনিক ব্যয়ও বেড়ে যায়। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বিকাশের ফলে এখন পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল রূপে রূপান্তর করা সম্ভব, যা স্বচ্ছতা, সময়সাশ্রয় ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে।

প্রথম ধাপে ডিজিটাল পরীক্ষা: নিরাপদ ও স্বয়ংক্রিয় মূল্যায়ন ব্যবস্থা

প্রথাগত পরীক্ষাগুলোতে একাধিক জটিলতা রয়েছে, বিশেষ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার খাতা পরিবহন, মূল্যায়নের দীর্ঘসূত্রিতা এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে দীর্ঘ বিলম্ব। এই সমস্যা দূর করতে প্রথম ধাপে এআই-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। পরীক্ষার খাতার প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটি গোপন কোড থাকবে, যা পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং অনিয়ম প্রতিরোধ করবে। পরীক্ষার শুরুর আগে প্রতিটি পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থী অনুযায়ী প্রশ্নপত্র ও খাতা সরাসরি প্রিন্ট হবে, ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেকটি খাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্যান হয়ে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষকের কাছে চলে যাবে, ফলে খাতা পরিবহন, সংরক্ষণ এবং হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। পরীক্ষার মূল্যায়নের জন্য প্রথমে দুইজন পরীক্ষক মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে খাতা মূল্যায়ন করবেন। যদি তাঁদের দেওয়া নম্বরে বড় ধরনের পার্থক্য থাকে, তবে সেই খাতা একজন তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হবে, যা নম্বর নির্ধারণের স্বচ্ছতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করবে। যেহেতু এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনে পরিচালিত হবে, তাই ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয় ধাপে ভার্চুয়াল খাতা ও এআই-প্রক্টরিং: পরীক্ষার নতুন দিগন্ত

প্রথম ধাপে পরীক্ষার ডিজিটাল রূপান্তর সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে, পরবর্তী ধাপে আরও উন্নত পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল খাতা ও রাইটিং প্যাড ব্যবহার করে পরীক্ষা দিতে পারবেন। পরীক্ষার্থীরা সরাসরি ডিজিটাল প্যাডে উত্তর লিখবে, যা এআই-ভিত্তিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষকদের কাছে পৌঁছে যাবে। এতে কাগজে লেখা, স্ক্যানিং, প্রিন্টিং এবং খাতা সংরক্ষণের প্রয়োজন থাকবে না, ফলে পরীক্ষার প্রক্রিয়া আরও গতিশীল ও পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠবে।

এই পদ্ধতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এআই-প্রক্টরিং প্রযুক্তি যুক্ত করা হবে। এটি পরীক্ষার পুরো সময় ৩৬০-ডিগ্রি ক্যামেরার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নজরদারিতে রাখবে এবং পরীক্ষা চলাকালীন কোনো ধরনের অনিয়ম হলে এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি শনাক্ত করতে পারবে। পরীক্ষার্থী যদি অনুমোদিত উপকরণের বাইরে কিছু ব্যবহার করেন বা অন্য কারো সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করেন, তবে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষককে সতর্কবার্তা পাঠানো হবে।

এই উন্নত ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর দীর্ঘমেয়াদী খরচ অত্যন্ত কম। গবেষণা অনুযায়ী, একটি ভার্চুয়াল খাতা ও ৩৬০-ডিগ্রি ক্যামেরার জন্য মাত্র ১০ হাজার টাকা খরচ হবে, যা দিয়ে তিন বছর পরীক্ষা পরিচালনা করা সম্ভব। তুলনামূলকভাবে, ম্যানুয়াল পরীক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাগজ, পরিবহন, পরীক্ষার হল ভাড়া, খাতা মূল্যায়ন ও প্রশাসনিক ব্যয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই এআই-ভিত্তিক পরীক্ষা ব্যবস্থা ম্যানুয়াল পরীক্ষার তুলনায় অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যকারিতা

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) দেশের বৃহত্তম দূরশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশ ছাড়াও বিদেশে অবস্থান করে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে এসব শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য দূতাবাস বা নির্দিষ্ট পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়, যা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ ও সময়সাপেক্ষ। এআই-ভিত্তিক অনলাইন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে পরীক্ষা দিতে পারবেন, ফলে বাউবির দূরশিক্ষা কার্যক্রম আরও সহজতর হবে এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য এটি আরও কার্যকর হয়ে উঠবে।

বিসিএস ও সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অনলাইন মূল্যায়ন: সময়ের দাবি

সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) বিসিএস পরীক্ষার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবার লাখ লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে, যার ফলে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর হয়ে পড়ে, যা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

এআই-ভিত্তিক অনলাইন পরীক্ষার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পরীক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল খাতায় উত্তর লিখবে এবং সেই খাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষকদের কাছে পৌঁছে যাবে। পরীক্ষকরা অনলাইনে মোবাইল ডিভাইস বা কম্পিউটারের মাধ্যমে মূল্যায়ন সম্পন্ন করতে পারবেন, যা খাতা পরিবহন ও সংরক্ষণের সময় ও ব্যয় কমাবে। এছাড়া, এআই-প্রক্টরড পরীক্ষা চালু হলে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি পরীক্ষায় নকল ও অনিয়ম কমে আসবে। বর্তমান পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল এবং অবৈধ সহযোগিতার অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। কিন্তু এআই প্রযুক্তি পরীক্ষার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশের শিক্ষা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা ব্যবস্থায় এআই-ভিত্তিক অনলাইন মূল্যায়ন চালু করা সময়ের দাবি। এটি কেবল পরীক্ষার স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করবে না, বরং খরচও সাশ্রয় করবে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি), বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা এবং সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থীরা এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে। লেখক এই সমন্বিত পদ্ধতির সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন।

এখন সময় এসেছে নীতিনির্ধারকদের এই আধুনিক পরীক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। ডিজিটাল মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে, নিয়োগ প্রক্রিয়া গতিশীল হবে এবং দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাংলাদেশকে বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি কার্যকর ও আধুনিক শিক্ষা কাঠামো তৈরি করবে।

লেখক: শিক্ষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ