`আগে মানুষ বানান, তারপর সেই মানুষ দিয়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন করুন'

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী হচ্ছে। শুধু বিদেশী অর্থ ঋণ না, বিদেশী বিজ্ঞানীও ঋণ করতে হয়েছে। পৃথিবীতে এমন আরেকটি দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে নিজ দেশের বিশ্বমানের নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ ও নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া এইরকম একটি ডেঞ্জারাসলি উচ্চ প্রযুক্তির প্রকল্প বিদেশী ঋণ ও বিদেশী বিজ্ঞানীর সহায়তায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের মত একটা সংবেদনশীল স্থাপনা বানায়। কারা রাশিয়ার সাথে দেনদরবার করল? কারা রাশিয়ার প্রস্তাব যাচাই বাছাই করলো?

এইসব করার মত যোগ্য মানুষ কি আমরা তৈরী করেছি? এইরকম সেনসিটিভ উচ্চ প্রযুক্তি নির্মাণের কথা বাদ দিন আমরাতো ওখান থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে এসে গ্রিডের সাথে সংযুক্তির জন্য যেই ট্রান্সমিশন লাইন লাগে সেটা বানানোর ক্ষমতাও নাই। একটা ট্রান্সমিশন লাইন তৈরির জন্য আমাদেরকে ভারতীয় কোম্পানির সাথে চুক্তি করতে হয়। তারা সেই জুলাই বিপ্লবের সাথে সাথেই দেশ থেকে চলে গেছে এখনো আসেনি। পুরো কাজটি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পরে গেল। 

একই কথা বলা যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ে। এটাও বিশাল অংকের টাকা খরচ করে সম্পূর্ণ বিদেশী প্রযুক্তিতে এবং বিদেশী বিজ্ঞানীদের দ্বারা করা হয়েছে। এর সাথে আমাদের নিজস্ব বিজ্ঞানীর কোন সম্পৃক্ততা ছিলনা বললেই চলে। চার বছর আগে ধনকুবের ইলন মাস্কের মালিকানাধীন স্পেসএক্স-এর নতুন প্রযুক্তির রকেট ফ্যালকন নাইনে করে যখন মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইটটি পাঠানোর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ মহাকাশে পদচিহ্ন আঁকা এলিট দেশগুলোর ক্লাবে প্রবেশের গৌরব অর্জনের পাশাপাশি এটা থেকে অনেক আয় করারও স্বপ্ন দেখেছিল। এই প্রকল্পে খরচ হয়েছিল ২৭০২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এই স্যাটেলাইট থেকে আয় হয় ১৫০ কোটি টাকা। বছরে ২০০ কোটি টাকা আয় ধরলেও এই স্যাটেলাইটের আর ১২ বছরের লাইফ স্প্যানে আয় হবে ২৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এটি টোটাললি একটি লস প্রজেক্ট। এখন শুনি বছরে ৬৬ কোটি টাকা লস হচ্ছে এই প্রজেক্ট থেকে। 

আরও পড়ুন: ঢাবিতে মেয়েদের জন্য নতুন দুটি আবাসিক হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত

চীনের ইঞ্জিনিয়ারেরা আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ করে দিল, জাপানের ইঞ্জিনিয়ারেরা আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল তৈরি করলো, রাশিয়ার বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ারেরা আমাদের আরেক স্বপ্নের মেগা প্রজেক্ট রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট বানাচ্ছে, কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ারেরা পার্বতিপুর খনি থেকে কয়লা উত্তোলণ করে দেয়, ফ্রান্সের কোম্পানি আর তাদের বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারেরা আমাদের টাকায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বানালো এবং তারাই আমাদের হয়ে উড্ডয়ন করে দিল। 

৫৩ বছরেও আমরা বিজ্ঞানী কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পারলাম না যারা বড় বড় সেতু বানাতে পারে, যারা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানো দূরে থাকে তদারকি করতে পারে, স্যাটেলাইট বানাতে পারে? না পারলে এইসবের পেছনে যেই অর্থ ব্যয় করেছি সেই অর্থ ব্যয় করে যদি আমরা বড় বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ার বানানোর কয়েকটি বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট তৈরী করতে পারতাম তাহলে দেশে উচ্চ মানের মানুষের সংখ্যা বাড়তো যার ফলে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্র বিশেষ করে সুশাসনেও প্রতিফলন ঘটতো। আমরা আগে মানুষ তৈরির কারখানা বানিয়ে মানুষ না তৈরী করে অন্য দেশের মানুষ দিয়ে এসব বানাচ্ছি। 

ভারত কি তা করেছে? তারা আগে মানুষ বানিয়েছে আর নিজেদের মানুষ দিয়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করছে এবং করেছে। তারা নিজেদের মানুষ দিয়ে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ও বোমা বানিয়েছে, নিজেদের মানুষ দিয়ে মেট্রোরেল, বড় বড় সেতু বানিয়েছে। এতে অর্থ সাশ্রয় হয়েছে, আরো বেশি এক্সপার্ট মানুষ তৈরি হয়েছে। কেন এখন পর্যন্ত একটা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সের মত প্রতিষ্ঠান বানাতে পারলাম না?

ভারত ২৪ টার মত আইআইটি বানিয়েছে আমরা কেন আইআইটির মত একটি প্রতিষ্ঠানও বানাতে পারলাম না? কেন আমাদের সুপার ধনীরা একটি টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মত একটা প্রতিষ্ঠান বানাতে পারলো না? বেক্সিমকো, সামিট, বসুন্ধরা কেবল জনগণের রক্ত চুষে খেয়ে বিশাল বিশাল ধনীই হলো। একটি প্রতিষ্ঠান বানালো না যেখানে বিশ্বমানের গবেষক তৈরি হয়। আমরা বলদরা নিজ দেশে উন্নত মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে নিজস্ব জনবল তৈরি না করে ঋণ করে বিলাসিতা করি।

আমি গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বলে আসছি: আগে মানুষ বানান তারপর সেই সোনার মানুষ দিয়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন করান। সেটা অর্থ সাশ্রয়ী ও টেকসই হবে এবং একই সাথে দুর্নীতি কম হবে। অমানুষ দিয়ে যা কিছুই করান সেটা কখনো ভালো হবে না।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence