সব কিছুর আগে সুখী, শিক্ষিত উচ্চ মানের শিক্ষক দরকার

অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ফটো

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কেউ খুশি যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে রান্না বান্না শিখছে, দলবদ্ধ হয়ে কাজ শিখছে, নাচ গান শিখছে, প্রকৃতিকে জানছে। একই কারণে আবার কেউ কেউ অখুশিও। কেউ খুশি কারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমা দেখে কারণ বলা যায় নতুন শিক্ষাক্রমে ট্র্যাডিশনাল পরীক্ষা প্রায় নাই। পরীক্ষার পরিবর্তে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখন থেকে ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন। আবার কেউ কেউ খুশি কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে আগের মানবিক বিভাগে যারা পড়তো তারা যতটা গণিত ও বিজ্ঞান পড়তো এখন তার চেয়ে বেশি পড়বে। এই যে কারো কারো কোন কোন ভালোলাগাকে ঢুকিয়ে বড় পর্দায় সর্বনাশ করার বিছানা বিছানো হচ্ছে সেটা অনেকেই বুঝতে পারছে না। কিভাবে হচ্ছে একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। মনোযোগ দিয়ে পড়লে কৃতজ্ঞ হবো। 

রান্না বান্না শিখছে, দলবদ্ধ হয়ে কাজ শিখছে, নাচ গান শিখছে, প্রকৃতিকে জানছে ইত্যাদির সাথে যদি রাস্তাঘাট পার হওয়া, ট্রাফিক আইন কিছুটা শেখানো, বাস ও ট্রেনে বৃদ্ধ ও সন্তানসম্ভবা কাউকে দেখলে সিট্ ছেড়ে দেওয়া, আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা শেখানো খুব জরুরি। প্রশ্ন হলো এইসব কোন ক্লাস পর্যন্ত সিলেবাসে ঢুকিয়ে টেনে নিয়ে যাব? বড়জোর পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ঠিক আছে। পৃথিবীর অন্য সব সভ্য দেশ যেমন জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশও তাই করে। 

আমিও তাই চাই। এই জন্য আমি অনেকদিন ধরে লিখে আসছি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফেজ হলো এই সময়টায়। এই সময়টাতেই নিয়মানুবর্তিতা, সততা, সমাজবদ্ধতা ইত্যাদি শিখে। এই বয়সের লেখাপড়াকে আনন্দময় না করলে লেখাপড়ায় ভীতি ঢুকে গেলে সেই শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার প্রতি আর আগ্রহ তৈরি নাও হতে পারে। এই বয়সের ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চ মানের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই জন্যই ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে ন্যূনতম মাস্টার্স পাশ এবং শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যারা বড় হয় তাদেরকেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো খুবই কঠিন ও শ্রমসাধ্য। এইজন্যই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের উচ্চ বেতন দেওয়া হয়। আমাদের ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষকরা অনেকটা এমন মানের। আমার দুই কন্যা এখনো তাদের ছোট ক্লাসের শিক্ষকদের কথা মনে রেখেছে। দেখা হলে এখনো গল্পে মেতে উঠে। কিন্তু বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক স্কুলের কথা ভাবুন। 

ফিনল্যান্ডে যেই মানের শিক্ষক দেয় সেই মানের শিক্ষকদের কোন সিলেবাস দেওয়া লাগে না। এরা যা বলবে, যা করবে এর সবই লেখাপড়ার অংশ। সক্রেটিসের কাছে প্লেটো, প্লেটোর কাছে এরিস্টটল পড়েছে। তাদের কাছে ছাত্ররা সারা দিন কাটিয়েছে, গল্প করেছে, আড্ডা দিয়েছে। তাদের কোন কারিকুলাম ছিল না। ওই মানের শিক্ষক হলে কারিকুলামও লাগে না। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকদের যদি বাংলাদেশের প্রাথমিক লেভেলের শিক্ষক দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয় তাহলে আমি নিশ্চিত ফিনল্যান্ডের শিক্ষার মান প্রায় বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষার মানে নেমে আসবে আর বাংলাদেশের শিক্ষার মান প্রায় ফিনল্যান্ডের শিক্ষার মানে উঠে যাবে। তাহলে কি দাঁড়ালো? সব কিছুর আগে সুখী, শিক্ষিত উচ্চ মানের শিক্ষক দরকার। কারিকুলাম তারাই ঠিক করে নিতে পারবে। কিসে অগ্রাধিকার দিতে হবে আমাদের নীতি নির্ধারকরা সেটাই জানে না। জানে হয়ত কিন্তু তাদের নিয়ত ভালো না। নিয়ত ভালো হলে সেটার প্রমাণ আগে দিত। কিভাবে সেটা দিত? প্রথমে জিডিপির কমপক্ষে ৫% শিক্ষায় বরাদ্দ দিত। ফলে শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান বৃদ্ধি করতো। ছেলেমেয়েদের বইয়ের কাগজের মান থেকে শুরু করে প্রচ্ছদের মান উন্নত করতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নত করতো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি ইঞ্জেক্ট করা বন্ধ করতো। এইসব না করে কেবল কারিকুলাম নামক খোলস পাল্টালেই কি শিক্ষার মান উন্নত হয়ে যাবে?

ফিনল্যান্ডে প্রাথমিকের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে ছোটবেলা থেকে যারা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছে তারা শিক্ষক হয়। ইন ফ্যাক্ট তাদের কারিকুলাম না থাকলেও তারা যা পড়াবে সেটাই কারিকুলাম হয়ে যাবে। একটি দেশের সমাজ ব্যবস্থা বুঝতে হবে। তাছাড়া একটি দেশের কারিকুলাম হঠাৎ করে শতভাগ পরিবর্তন করা একটা ক্রাইম। পৃথিবীর কোথাও কখনো করে না এবং করবে না। যদিও আমার কনসার্ন ক্লাস ফাইভ সিক্স নিয়ে নয়। আমার বেশি কনসার্ন অষ্টম শ্রেণী থেকে যেখানে বিজ্ঞান গণিতকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।

আমার কনসার্ন যারা এই শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করছে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে। তারা কেন কেবল বাংলা মাধ্যম নিয়ে এত কাটাছেঁড়া করে? আমার সন্দেহ জাগে। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সন্দেহ  জাগে তখন যখন দেখি তারা কেবল গরিব ও মধ্যবিত্তের সন্তানদের শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলে: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা’র অভিলক্ষ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে, গভীর শিখনের বিষয়ে গুরুত্বে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের অগ্রাধিকার প্রদান করা। 

তাহলে এই যে হাজার হাজার ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চবিত্তের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে তাদের জন্য কি এই উদ্দেশ্য প্রযোজ্য না? তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় হওয়ার দরকার নাই? তাদের কি দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক হওয়ার প্রয়োজন নেই? তাদের কি আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশের প্রয়োজন নাই? তাদের কি বাউল গান, জারি সারি গান, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র সংগীত নজরুলগীতি জানার প্রয়োজন নাই? তাদের কি বাংলা সাহিত্য পড়ার দরকার নাই? তাদের কি বাংলা সিনেমা নাটক দেখার প্রয়োজন নাই? তাদের কি রান্নাবান্না, ঘর গোছানো ইত্যাদি শেখার প্রয়োজন নাই? এই দুই গ্রুপ যখন এক সাথে হবে তারা মিশবে কিভাবে? আপনাদের বাংলা মাধ্যমের প্রতি অতি ভালোবাসা আর ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি উদাসীনতা দেখে আমার সন্দেহ জাগে। আপনারা যারা নীতি নির্ধারণীতে আছেন আপনাদেরতো সবাইকে নিয়ে ভাবার কথা! 

উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের চেয়ে তথ্য প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট হতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও এইটা নাই। এই কাজগুলো যারা করেছে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য আছে আমি নিশ্চিত।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ