শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ‘ফ্রি হ্যান্ড লাইসেন্স’ এদেশেই সম্ভব

অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

পদার্থবিজ্ঞানে হঠাৎ বড় পরিবর্তন করাকে প্রায় নিষিদ্ধ করেছে। যেমন একটি সিলিন্ডারে গ্যাস রেখে তার উপর উপর নিচ করা যায় এমন একটি পিস্টন রাখা হয়। পিস্টনটিকে নিচে নামলে গ্যাসের ভলিউম কমে এবং তাতে গ্যাসের চাপ ও তাপমাত্রা বাড়ে। এই চাপ, ভলিউম ও তাপমাত্রার সম্পর্কের থার্মোডাইনামিক্স জানতে হলে পিস্টনটির উপর একটি একটি বালুর কণা রেখে খুব ধীরে ধীরে নিচে নামাতে হবে অথবা একটি একটি করে বালুর কণা তুলে পিস্টনটিকে উপরে উঠাতে হবে যেন এই কাজের সময় গ্যাসের ইকুইলিব্রিয়ামের ক্ষতি না হয়।

এইরকম আরো উদাহরণ দেওয়া যাবে যেমন স্প্রিঙের পোটেনশিয়াল এনার্জি মাপতে হলে স্প্রিঙকে ইনফিনিটসীমাল পরিমান করে সংকোচন বা প্রসারণ করার জন্য রেস্টোরিং বল থেকে ইনফিনিটসীমাল পরিমান বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা এর ফিজিক্সটা জানতে পারি। হঠাৎ ধপাস করে কিছু করা যাবে না। পিস্টনকে ধপাস করে অনেক উপরে বা অনেক নিচে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

তেমনি বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রেও কোন কিছুটা হঠাৎ করে ধপাস করে আমূল পরিবর্তন করার চেষ্টা করা উচিত না। অথচ ঠিক এই কাজটিই করে আসছে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি। একবার "এসো নিজে করি" নামক ফালতু একটা সিস্টেম আমদানি করে পরে সেটা বাতিল করেছে। তারপর "সৃজনশীল" নামক একটি পদ্ধতি আনলো। এরপর হঠাৎ করে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয় পরীক্ষা সিস্টেম চালু করল। তারপর হটাৎ করে এইগুলো বাদ দিল। তখন বলা হলো পরীক্ষার ভয় কাটানোর জন্য ওই দুটো পরীক্ষার সূত্রপাত। তারপর এখন শুধু এইগুলোই বাদ না অন্য অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষাই না রাখার পক্ষে। মানে ভয় দূর করার জন্য পরীক্ষাকেই বাদ দেওয়ার পদ্ধতির আবিষ্কার। এর সাথে আবার স্কুল কলেজের পুরো কারিকুলামে আমূল পরিবর্তন করার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এত অল্প সময়ে এতবার এত পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোথাও আছে? তারা নিয়ম করে। তারপর সমালোচনা হয় এবং দেখে নিয়ম ব্যর্থ পরে নিয়ম বাদ। কিন্তু কারো শাস্তির ব্যবস্থা নাই। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ফ্রি হ্যান্ড লাইসেন্স কেবল বাংলাদেশের বাংলা মাধ্যমেই সম্ভব।

ইংরেজি মাধ্যমের সাথে আমার ঘনিষ্ট যোগাযোগ অনেক বছর যাবৎ। মাঝে আমার কন্যাদের স্কুলের কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য ওখানে এ-লেভেলে কিছু ক্লাসও নিয়েছিলাম যাতে স্কুলের নানা পরিবর্তনের জন্য আমি কিছু কার্যকর মতামত দিতে পারি এবং দিয়েছিলামও। আজ বেশ অনেক দিন হয়ে গেল আমার উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ার পর সেখানে পড়ানো বাদও দিয়েছি। নিজের দুই কন্যা স্কুলে থাকার কারণে স্কুলের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত থেকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের কারিকুলাম সম্মন্ধে আমার যথেষ্ট ভালো ধারণা আছে। এত বছর এর অভিজ্ঞতায় দেখেছি এরা এদের কারিকুলামে প্রতি ২/৩ বছর পর পরই পরিবর্তন আনে কিন্তু কখনোই আমূল হঠাৎ করে আমূল পরিবর্তন আনে না। একটু একটু পরিবর্তন প্রায় প্রতি বছরই হয়। আর আমরা কি করলাম? পরীক্ষার পদ্ধতি, কারিকুলাম ইত্যাদি সব হঠাৎ করে বিশ্বের সেরা উন্নত দেশের মডেলের নাম তুলে পেস্ট করে দিলাম। কারিকুলামতো একটা স্কেলেটন মাত্র। আসলতো হলো শিক্ষকের মান, শিক্ষকের বেতন, শিক্ষকের সম্মান, স্কুলের অবকাঠামো ইত্যাদি। তার সাথে আমাদের সমাজ এবং আমাদের সমাজের সামাজিক অবস্থা। ইত্যাদি বিবেচনায় না নিয়েই একটা কারিকুলাম পরিবর্তন করলেই শিক্ষার মান ভালো হয়ে যাবে? কি ভয়াবহ চিন্তা! এইরকম অসুস্থ চিন্তা করতে পেরেছে কারণ এদের উদ্দেশ্য আমাদের ছেলেমেয়েদের মঙ্গলের কথা ভেবে নয়। এরা করেছে এটাকে মেগা প্রজেক্ট হিসাবে দেখে এখান থেকে অনেক টাকা মারা যাবে সেই বিবেচনায়। কি নির্মমতা!

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ