শিক্ষক লাঞ্ছিত হলে পুরো সমাজ লাঞ্ছিত হয়

লেখক: মু. আব্দুল্লাহ আল নাঈম।
লেখক: মু. আব্দুল্লাহ আল নাঈম।  © সংগৃহীত

শিক্ষক হচ্ছে জ্ঞানের কান্ডারী। মানুষ গড়ার কারিগর। সমাজের সম্মানিত মানুষ। কিন্তু এই মানুষকে যখন লাঞ্ছিত করা হয় তখন পুরো সমাজকেই লাঞ্ছিত করা হয়। গত রোববার (৮ অক্টোবর) দুপুরে চুয়াডাঙ্গার ভিক্টোরিয়া জুবিলি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণির ছাত্র কর্তৃক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (বাংলা) মো. হাফিজুর রহমানের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা জাতিকে নির্বাক করে দিয়েছে। শিক্ষকের দোষ— সে বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির নির্বাচনি পরীক্ষায় এক শিক্ষার্থীকে অসদুপায় অবলম্বন ও বিশৃঙ্খলায় বাধা প্রদান করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষার নিয়মকানুন যথাযথভাবে মানছিল না। প্রথমবার অনিয়ম করায় শিক্ষক স্থান পরিবর্তন করে কক্ষের অন্য বেঞ্চে বসান, তবুও সে অসদুপায় অবলম্বন ও বিশৃঙ্খলা করেই যাচ্ছিল। তখন ভুক্তভোগী শিক্ষক তার খাতাটি নিয়ে নেন এবং বসতে বলেন। কিন্তু ওই শিক্ষার্থী তার নির্ধারিত আসন থেকে উঠে শিক্ষকের ওপর চড়াও হয় এবং একপর্যায়ে চড়-থাপ্পড় মেরে বসে।

আরো পড়ুন: রাবিতে শিক্ষক লাঞ্ছিত, গুলি করে হত্যার হুমকি! (ভিডিও)

আমি ভিডিওটি কয়েকবার দেখেছি। যতবার দেখেছি ততবারই নির্বাক হয়েছি, বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি শিখছি আমরা, শিক্ষকরাই বা আমাদের কি শিখাচ্ছেন। যারা নিজ হাতে শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন সেই শিক্ষকের শরীরে হাত তোলাসহ গালে চড়-থাপ্পড় মারতে কোন দ্বিধাবোধই করেননি ছাত্রটি। শিক্ষার্থী নামধারী এ কেমন আদবহীন মানুষ তৈরি হচ্ছে দেশে।

শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার কারণ কি! সমস্যাটি আসলে কোথায়?

শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা একটি নিকৃষ্ট এবং গর্হিত কাজ। যা কখনও চিন্তা করা যায় না। শিক্ষকরা অপমানিত হওয়ার কিছু কারণ রয়েছে। এরমধ্যে একটি হল— শাসনের অভাব। শিক্ষকের হাত থেকে যেদিন বেত তুলে নেয়া হয়েছে, সেদিন থেকে শিক্ষার্থীরা প্রশ্রয় পেয়ে গিয়েছে। তারা মনে করছে, আমাদেরকে শাসন করার কেউ নেই, শিক্ষকতো আমাদের শাসন করেই না। আমাদের যা ইচ্ছে আমরা তাই করতে পারি। এজন্য শিক্ষকদেরকে নিয়ম করে মাত্রানুযায়ী শাসন করার স্বাধীনতা প্রদান করা এখন সময়ের দাবি।

আবার আরেকটি কারণ হচ্ছে— নিজ এলাকার দাম্ভিকতা। নিজস্ব গ্রাম কিংবা এলাকাভিত্তিক বাপ-দাদার জমিজমা ও টাকা-পয়সার জোর দেখানো কিংবা এলাকার নোংরা রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ফলে বিভিন্ন সময়েই শিক্ষককে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। ছাত্র রাজনীতির নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু সন্ত্রাসীরা ৯ম-১০ম শ্রেণিসহ ছোট ক্লাসে পডুয়া শিক্ষার্থীদেরকে শেল্টার দিয়ে থাকে। এবং তারা বলে এও বলে থাকে— তোরা যাই করিস না কেন, আমি বড় ভাই তো আছিই! এরকম নোংরা চিন্তা-চেতনার কারণে শিক্ষার্থীরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এদেরকে আলোর পথ আনতে হবে। 

আরো পড়ুন: ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ

আবার অন্যদিকে সন্তানকে শাসন করার ফলে কিছু দাম্ভিক পিতামাতাও শিক্ষককে হুমকি-ধমকি প্রদানসহ লাঞ্ছিত করে থাকেন। বিদ্যালয়ে কিংবা বাসায় গিয়ে অপমানের সুরে তারা শিক্ষকের কাছে কৈফয়ত চান, বলেন— আপনি আমার সন্তানকে মারলেন কেন? হু আর ইউ! অভিভাবকদের এমন আচরণের বিরুপ প্রভাব পরে সেই শিক্ষার্থীর উপর।

নৈতিকতায় ফিরে আসতে হবে:

দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা মূল্যবোধ ও নৈতিকতাপূর্ণ মানুষ গড়ে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। যা সমাজ, গণমাধ্যম ও বাস্তবতার দিকে লক্ষ্য করলে খুব সহজেই অনুমেয়। এজন্য আমাদের সন্তানদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শেখানো প্রয়োজন। সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হলে একজন শিক্ষার্থী কখনো বেয়াদব হিসেবে সমাজে, পরিবারে কিংবা বিদ্যালয়ে পরিচিতি পাবেনা। এ বিষয়ে অবশ্যই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা প্রশাসন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এবং ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীকে কর্তব্য পালনে বাধাপ্রদান, আক্রমণ, অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ এবং আঘাতসহ ভয়ভীতি প্রদানের অপরাধে ৩৩২, ৩৫৩ এবং ৫০৬ ধারায় চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) দুপুরের দিকে যশোরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে হাজির হয়ে ওই শিশু জামিনের আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু তালেব জামিন নামঞ্জুর করে শিশু সংশোধনাগারে পাঠিয়েছেন।

এখন সর্বশেষ করণীয় হচ্ছে, যদি চুয়াডাঙ্গা প্রশাসন এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সমগ্রদেশে। আজ চুয়াডাঙ্গায় হয়েছে, কাল হবে অন্য কোন জেলায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা। 


সর্বশেষ সংবাদ