মা-বাবাকে ঈদ পোশাক কিনে দিতে চেয়েছিলেন প্রীতি

প্রীতি
প্রীতি   © সংগৃহীত

প্রীতির আঙ্গুলের পরশ মাখা পানি খাওয়ার মগটিও সযত্নে রেখে দিয়েছেন মা। এ মগে এখন আর কেউ পানি খায় না। বইগুলো রয়েছে, পড়ার টেবিলও। তবে? 

তবে কিছুই এখন মায়ের চোখের সামনে নেই। প্রীতির ব্যবহার করা জিনিসগুলো দেখলেই মায়ের বুকটা ফাঁকা লাগে। দু’চোখ জুড়ে অশ্রু আসে। তাই পরকালের বাসিন্দা প্রীতির ব্যবহার করা কোন জিনিসই নিজের চোখের সামনে রাখেননি মা হোসনে আরা। প্রীতির প্রতিটি চিহ্ন বুকে পাথর বেঁধে একে একে সরিয়ে দিয়েছেন মা। প্রীতির ঘরটিও নতুনত্বে সাজিয়েছেন।

যেই প্রীতি পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো সেই বাড়ি এখন কঙ্কালসার। শোকের মাতম হয়তো কিছুটা কেটেছে। তাই বলে কি মায়ের… 

প্রীতির মা হোসনে আরা জানান, কোথাও শান্তি নেই। প্রীতির কোন কিছু দেখলেই মনে হয় ও তো এখানেই বসে ছিল। এখন প্রীতি এটা করতো, ওটা করতো। বুকটা একদম ফেটে আসে। 

গত ২৪ মার্চ, বৃহস্পতিবার রাতে শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। সেই গুলিতে রিকশায় থাকা সামিয়া আফনান জামাল প্রীতি নিহত হন।

ফ্রিল্যান্সিং করার জন্য ঈদের পর প্রীতিকে একটি ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বাবা জামাল উদ্দিন। তিনি জানালেন, প্রীতি মারা যাওয়ার আগে একটা রেস্তোরাঁয় তিন-চার মাস কাজ করছিল। বসুন্ধরা সিটিতে একটা কোম্পানিতে চাকরিও পেয়েছিল। ১ এপ্রিল থেকে কাজে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। বেতন ১৫ হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে আমাদের ঈদের জামা কিনে দেবে বলে জানিয়েছিল। তা আর হলো না।

জামাল উদ্দিন জানান, ঈদ সব সময়ই আনন্দের। তবে মন সায় দেয় না। এটা অন্যরকম কষ্ট। ঈদুল ফিতরে মেয়ের কবরে যাব। জিয়ারত করব। আল্লাহর নিকটে দোয়া করব। এতেই হয়তো মনটা হালকা হবে। 

তিনি আরও জানালেন, ওর কোনো চাহিদা ছিল না। মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। যত চাহিদা সব মাকেই বলতো। তেমন কিছু ওরে দিতে পারিনি। এখন খুব আফসোস হচ্ছে।  

এ বছরও পুরো রমজানজুড়ে ইফতার আয়োজন হয়েছে। তবে কেউ এসে বলেনি মা ইফতারে কি বানাবে? কেউ ইফতারের কাজে হাতে লাগায়নি। এক মাসের বেশি হয় প্রীতি নেই। চুপচাপ ইফতার সেরেছেন তারা। 

হোসনে আরা জানান, আগে পায়ে চালিত মেশিন ছিল। প্রীতি দুই মাস একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছিল। সেই কাজের টাকা দিয়ে তাকে নতুন মেশিন কিনে দেয় প্রীতি। এবার নতুন কোনো অর্ডার নেননি তিনি। মারা যাওয়ার আগে কিছু অর্ডার নেওয়া ছিল, সেইগুলোই কাজ করেছেন তিনি।

মা জানালেন, প্রীতি ভীষণ প্রাণচঞ্চল ছিলেন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলত। একদম রাগ ছিল না। কুকুর–বিড়ালের প্রতি অনেক মায়া ছিল। রাস্তায় বিড়ালের বাচ্চা দেখলেই বাসায় নিয়ে আসত প্রীতি।  

প্রীতির বিড়ালপ্রীতির কিছু ছবিও দেখালেন মা হোসনে আরা। প্রীতির সবচেয়ে প্রিয় বিড়াল পিকু সদ্য পাঁচটি বাচ্চাও জন্ম দিয়েছে। তবে প্রীতি তা দেখে যেতে পারলো না। প্রীতি যে খাটে ঘুমাত, তারই নিচে একটি বক্সে বিড়ালগুলোও সংসার পেতেছে। প্রীতির মা হোসনে আরা পিকুর সেই সংসার আগলে রেখেছেন।

প্রীতির একটি নোটবুক দেখালেন মা হোসনে আরা। এতে টম অ্যান্ড জেরি, ডোরেমন, পিকাচুসহ নানান কার্টুন চরিত্রের চিহ্ন রয়েছে। প্রীতি মডেলিং ও অভিনয়ের শখ ছিল। তবে পরিবার তাতে সাড় দিত না। প্রায় ১২ বছর হয় তারা ঢাকায় এসেছেন। এখানেই কেটেছে প্রীতির ছেলেবেলা। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখানেই কলেজে ধাপে অগ্রসর হয়েছিল প্রীতি। 

২০১৬ সালে এসএসসি পাস করে প্রীতি। ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগও পেয়েছিল প্রীতি। তবে আর্থিক সংকটে মেয়েকে সেখানে ভর্তি করাতে পারেনি প্রীতির পরিবার। 

এ নিয়ে মা হোসনে আরার বেশ আফসোস। তিনি জানালেন, ওরে যদি একটু সাপোর্ট দিতে পারতাম, তাহলে ও হয়তো অন্য জায়গায় থাকত। প্রীতির বাবার স্বল্প বেতনের চাকরি! এ বেতনে বাসা ভাড়া, সংসারের খরচ, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারতেন না। একসময় প্রীতি নিজেই চাকরি খুঁজতে শুরু করে।

অবসরে প্রীতি মেহেদি পরতেন। আপন আঙিনার হৃদ গহীনে থাকা নকশায় নকশায় মেহেদির রঙে নিজেকে সাজাতেন। মা হোসনে আরা আরও জানালেন, ঈদের চাঁদ উঠলেই আশেপাশের শিশুরা প্রীতির বাসায় চলে আসতো। সঙ্গে থাকতো মেহেদী। ঈদে আশেপাশের বাচ্চাদের মাঝরাত পর্যন্ত মেহেদী লাগিয়ে দিতো। এবার কেউ হয়তো আর মেহেদী দিতে বাসায় আসেনি।

এভাবেই হয়তো প্রীতির মায়ের বুকচেরা আক্ষেপে ঈদ কেটে যাবে। বছর পেরিয়ে আবারও ঈদ আসবে। সেই ঈদগুলোও প্রীতিকে ছাড়াই কেটে যাবে। ঈদের আনন্দ হোসনে আরার ঘরে আর ফিরবে না। তাই তো কান্নাজড়িত গলায় প্রীতির মা জানালেন, দিন তো চলে যায়, কিন্তু কীভাবে কাটে আমি জানি না।
 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence