ছেলের জন্য ‘হালুয়া’ বানিয়ে অপেক্ষায় থাকেন মা

শহীদ পারভেজ
শহীদ পারভেজ  © সংগৃহীত

শহীদ পারভেজের শোকাহত মা কানিজ ফাতেমা প্রিয় সন্তানের বিদায় দৃশ্য দেখেছেন। তবু এখনো প্রতীক্ষায় থাকেন ছেলে ফিরবে বলে। কিন্তু তার এ অপেক্ষা যে কখনো ফুরাবে না, এ কথা জেনেও তিনি একমাত্র ছেলের ডাক শোনার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করেন। একমাত্র অবলম্বন ও আনন্দের উৎস ছিলেন যে ছেলে, তাকে হারানোর শোক কীভাবে বয়ে বেড়াবেন ফাতেমা, তা এখন দুঃসহ বিষয়।

শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে বিজয় মিছিলে যোগ দেন পোশাকশ্রমিক পারভেজ (৩১)। আনন্দ করার সময় হঠাৎ পুলিশের গুলি এসে লাগে তার শরীরে। ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।

সরেজমিনে নগরীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল পশ্চিমপাড়া এলাকার বাড়িতে গেলে শহীদ পারভেজের মা ফাতেমা তার যন্ত্রণার কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি বলেন, ‘আমার প্রিয় ছেলের মৃত্যুর পর থেকে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার মনে হয় সে তার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আসবে এখন। আগের মতো আমাকে গেট খুলে দিতে বলবে।’

ছেলের কর্মস্থল থেকে ফেরার জন্য ফাতেমা প্রতি রাতে বাড়িতে অপেক্ষা করতেন আগে। সেই স্মৃতি মনে করে দুঃখ ভারাক্রান্ত ফাতেমা বলেন, আমার ছেলে রাতে বাসায় এসে মিষ্টি কণ্ঠে ডাকত, ‘আম্মু, প্লিজ গেট খোলো, আমি ঘুমাবো।’ কিন্তু এখন গেট খুলতে কেউ ডাকে না আমায়। তবু আমি রাত জেগে তার জন্য অপেক্ষা করি।’

খুলনার এক দরিদ্র ও ভূমিহীন দম্পতি খোকন মিয়া ও ফাতেমা ৩০ বছর আগে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পেশায় একজন নির্মাণশ্রমিক খোকন ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে ২৮ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন।

ছয় সন্তানকে বড় করে তোলার পাহাড়সম চাপ পড়ে তার মাথায়। নিরুপায় হয়ে তিনি তার দুই মেয়েকে দত্তক দিতে বাধ্য হন। তারপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যে একমাত্র ছেলে পারভেজ এবং অন্য তিন মেয়েকে মানুষ করেন। তাদের মধ্যে পারভেজ কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পারভেজ মাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য ১৪ বছর বয়সে কাজ শুরু করেন। তিনি মায়ের সবচেয়ে একমাত্র অবলম্বন ছিলেন। এমনকি তিনি তার মায়ের যত্ন নিতে অস্বীকার করায় তার স্ত্রীকেও তালাক দিয়েছিলেন।

সীমাহীন কষ্টে দিশেহারা ফাতেমা নিজের কপাল চাপড়ে বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছি। কিন্তু আমার ছেলে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং আমাকে সুখের স্বাদ দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমার কপালে সে সুখ সইল না।’

পারভেজকে কর্মঠ ও নিঃস্বার্থ বর্ণনা করে ফাতেমা বলেন, আমার ছেলে তার সামান্য উপার্জন সত্ত্বেও সব সময় আমার সুখের দিকে খেয়াল করত। আমার যত্ন নিত। আমাদের প্রয়োজন মেটাতে এবং আমাদের সুখী করতে সে অক্লান্ত পরিশ্রম করত এবং ছুটির দিনেও কাজ করত। সে তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও বোনদের খোঁজখবর নিত এবং তাদের প্রয়োজন মেটাত।

তার প্রতি পারভেজের ভক্তির কথা স্মরণ করে কেঁদে ওঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে অনেক ভালোবাসত। সে লাউড স্পিকারে ‘খোদার পরে এই অন্তরে আছেন আমার আম্মা’ গানটি বাজাত। আমি কি হারিয়েছি, তা একমাত্র আল্লাহ ও আমি জানি।’

মৃত্যুর আগে ছেলেকে পছন্দের খাবার খাওয়াতে না পারায় এখন সেই যন্ত্রণায় ভুগছেন ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর আগে আমার ছেলে বুটের ডালের হালুয়া খেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি খুব অসুস্থ থাকায় তৈরি করে খাওয়াতে পারিনি। এখন আমি ঘরে হালুয়া বানাই কিন্তু খাওয়ার মানুষটা নাই।’

ফাতেমার একমাত্র অবলম্বন পারভেজের মৃত্যু তাকে কেবল মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত করেনি, ভয়াবহ আর্থিক সংকটেও ফেলে দিয়েছে। কারণ পারভেজের বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। ফাতেমাকে এখন বেঁচে থাকার জন্য তার মেয়েদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

তিনি জানান, এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ ১০ হাজার  টাকা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৭২ হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছে। তার দুই পা ভেঙে গেছে এবং প্রতি মাসে তার ৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এ জন্য জামায়াতের অনুদানের টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তার লভ্যাংশের টাকায় ওষুধের খরচ মেটাচ্ছেন।

আন্দোলনের দিনগুলোতে পারভেজের স্মৃতি স্মরণ করে ফাতেমা বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের দমন করায় তার ছেলে বিরক্ত ছিল। একদিন পারভেজ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কি কোনো যুবককে বাঁচিয়ে রাখবেন না? তিনি সব মানুষকে হত্যা করছেন। আমি গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু দেখেছি।’

ফাতেমা সে সময় তাকে অফিসে যেতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি জানান, প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারের পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গত ৫ আগস্ট বিকেলে পারভেজ বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেল থেকে ৬ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি নিজেই আমার ছেলের খোঁজ করেছি। তাকে খুঁজে না পেয়ে বড় মেয়ে নাজমা আক্তার বৃষ্টির বাড়িতে গিয়ে তাকে জানাই।’

ভাইকে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজির কথা স্মরণ করে বৃষ্টি বলেন, ‘আমরাও সেদিন বিকেল ৪টার দিকে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু পারভেজ যে যাত্রাবাড়ী গেছে, তা আমরা জানতাম না। মায়ের কাছে খবর শুনে ফোনে পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পাভেজের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিই। পরে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে মর্গে অনেক লাশের মধ্যে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই।’

পারভেজের শাহাদাতের সময় ও স্থান সম্পর্কে বৃষ্টির বর্ণনা থেকে জানা যায়, একটি ভিডিও দেখে এবং ডাক্তারি নথি বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে পারভেজকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বেলা আড়াইটার দিকে গুলি করা হয় এবং মুগদা হাসপাতালে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।


সর্বশেষ সংবাদ