‘আপনাদের তালা আমি ভেঙে দেব, তবে আমাদের বাঁচাতে হবে’
- নাছির আহমেদ
- প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ PM , আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ PM
‘হঠাৎ পুলিশের এক সদস্য কান্না করতে করতে এসে বলছেন, “হাসিনা পালায় গেছে।” তখনই থানার ওসিসহ বাকি অফিসাররা অস্ত্রাগার, সেল, গেটের চাবি নিয়ে পালানো শুরু করে। বাইরে থেকে আন্দোলনরত ছাত্ররা থানা ঘেরাও করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন থানার ভেতরে ঢুকছে। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমরা তখন জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।’
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথোপকথনে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক ও করুণ কাহিনি এভাবেই বর্ণনা করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমন আহমেদ ইয়ামিন।
গত ৫ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন ইমন আহমেদ ও তার চার বন্ধু। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তাদের আটক করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। তারপর তাদের নেওয়া হয় থানা হাজতে।
ইমন লেখেন, ‘যাত্রাবাড়ী এলাকায় পৌঁছালে আমাদের গ্রেফতার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। থানায় নেওয়ার পর ওসিসহ আরও অনেকে আমাদের গালাগালি করে, গায়ে হাত তোলে এবং গুলি করার হুমকি দেয়। আমাদের নামে মামলা দেবে বলে সবার নাম-ঠিকানাও নেয়। তারা আমাদের সবার মোবাইলসহ যাবতীয় জিনিস রেখে থানাহাজতে ঢোকায়।’
‘তখন সকাল ৮টা বাজে। সকাল থেকে কিছু খাইনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। তখনো কোনো খাবার দেওয়া হয়নি আমাদের। তবে ভয় আর আতঙ্কে ছিলাম আমরা। বিকাল ৩টার সময় হঠাৎ পুলিশের এক কনস্টেবলের কথা শুনে আমরা হতভম্ব।’
ইমন বলছেন, ‘এক পুলিশ সদস্য কান্না করতে করতে এসে বললেন হাসিনা পালায় গেছে। এটা শুনে থানার ওসিসহ বাকি অফিসাররা অস্ত্রাগার, সেল, গেটের চাবি নিয়ে পালানো শুরু করে। এর মধ্যেই ছাত্ররা থানা ঘেরাও করে আগুন লাগিয়ে দেয়। অন্য এক কনস্টেবল ফোনে কাকে যেন বলছেন “আমাদের তারা মেরে ফেলবে, আমাদের বাঁচান।” আরেক সদস্য ফোনে কাঁদছেন আর বলছেন, “স্যার আমাদের বাচাঁবেন না? ছাত্ররা আমাদের মেরে ফেলবে, একটা হেলিকপ্টার পাঠান স্যার, আমাদের বাঁচান স্যার, আমাদের বাঁচান।’
ততক্ষণে পুরো থানায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভয় পেয়ে যান ইমন ও তার বন্ধুরা। তিনি বলেন, ‘আগুন আমাদের সেলের ভেতরে ঢুকছিল, সারা দিন না খেয়ে থাকার কারণে আগুনের তাপে আমাদের সেলের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে তালাও ভাঙতে পারছিলাম না। আমাদের কান্নাকাটি দেখে এক পুলিশ সদস্য এসে দুটি গুলি করেন তালার মধ্যে, তাতেও ভাঙেনি। আগুনও ভেতরে ঢুকছে। আমরা তখন জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।’
‘অন্য এক পুলিশ সদস্য এসে বললেন, “আপনাদের তালা আমি ভেঙে দেব, তবে আমাদের বাঁচাতে হবে।” আমরা রাজি হলাম। অনেক চেষ্টার পর তালা ভাঙতে সক্ষম হন। বেরিয়ে এসে দেখি চারদিকে আগুন। বাইরে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। পরে আমাদের পোশাকগুলো খুলে পুলিশকে দিই। তারা তাদের ইউনিফর্ম খুলে আমাদের পোশাক পরে বের হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ছাত্র-জনতা তাদের চিনে ফেলে। পরে কয়েকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।’
লাশের স্তূপ দেখে ভড়কে যান ইমন ও তার বন্ধুরা। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বের হওয়ার জন্য এগিয়ে যাই, দেখি থানার সামনে লাশের স্তূপ। পুলিশ আন্দোলনরত ছাত্রদের মেরে থানার সামনে স্তূপ করে রেখেছে। মেইন গেটে তখনো তালা ঝুলছিল। তাই আমরা অপেক্ষা না করে দেয়াল টপকে সেখান থেকে জান নিয়ে বেরিয়ে আসি।’
কেন আন্দোলনে যোগ দিলেন, এমন প্রশ্নে ইয়ামিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আসলে শিক্ষার্থীদের প্রথমে দাবি ছিল কোটা নিয়ে। কিন্তু সরকার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়, তখন আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নেয়। যত দিন যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হচ্ছে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আর ঘরে বসে থাকা যায় না। এ জন্য আন্দোলনে যোগ দিই।’
সরকারের পতন চাননি জানিয়ে ইমন বলেন, ‘শুরুতে তো আমরা তা চাইনি। কিন্তু যখন কারও দাবি না মেনে তাদের গুলি করে মারা হয়, তখন আর শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। তাই শুরুতে তার পতন না চাইলেও পরে আর উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিজয় হয়েছে।’
ভবিষ্যতে একটি উন্নত বাংলাদেশ দেখতে চান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষর্থী ইমন। দেশে থাকবে না কোনো নোংরা রাজনীতি। হানাহানি, নিশ্চিত হবে সুশাসন ও বিচার। সবাই দেশকে ভালোবাসবে। সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলবে- এমন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন তারা।
ইমন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দিয়ে নতুন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চাই এই দেশে আর কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। প্রত্যেক নাগরিক তার মনের কথা বলবে, তার অধিকার ফিরে পাবে, সুন্দর একটি দেশে বসবাস করবে। আগেও উন্নয়ন হয়েছে, তবে পাশাপাশি অনেক লুটপাট-দুর্নীতি হয়েছে। আমরা এখন দেশের সংস্কার চাই। যদিও এখনো আশানুরূপ কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবে পরিবর্তন আসবে বলে আশা রাখি।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। মুহূর্তেই চারদিকে শুরু হয় বিজয়োল্লাস। তবে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বিভিন্ন থানা ও পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাত্রাবাড়ী থানা। পুরো থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। থানার ভেতরে সাত পুলিশ সদস্য নিহত হয়।