বুলেটে প্রাণ গেল মাদ্রাসাছাত্র আয়াতুল্লাহর, নিভে গেল আলেম হওয়ার স্বপ্ন

শহীদ আয়াতুল্লাহ
শহীদ আয়াতুল্লাহ  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে গিয়ে নিভে গেলো মাদ্রাসা ছাত্র আয়াতুল্লাহ’র বড় আলেম হওয়ার স্বপ্ন। গত ৫ আগস্ট  স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে শফিপুর আনসার একাডেমির সামনে শহিদ হন আয়াতুল্লাহ। তার পিতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আয়াতুল্লাহকে বড় আলেম বানানোর ইচ্ছে ছিল। 

পুত্রশোকে কাতর শহিদ আয়াতুল্লাহ’র পিতা সিরাজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, “গত ৫ আগস্ট সোমবার গাজীপুরের শফিপুরে অবস্থিত আনসার ভিডিপি একাডেমির সামনে গুলিবিদ্ধ হয় আমার ছোট ছেলে মো.আয়াতুল্লাহ (১৯)। বড় ভাই সোহাগ মিয়ার সাথে ওইদিন সে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিল। মিছিলটি বিকেল পাঁচটার দিকে কালিয়াকৈরের মৌচাক পয়েন্ট থেকে আনসার একাডেমির কাছে পৌঁছালে এলোপাতাড়ি গুলি আসতে থাকে। 

এতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ছাত্র-জনতা। দুই ভাই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাড়ে ৫টার দিকে আয়াতুল্লাহর সঙ্গে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কথা হয় সোহাগের। এরপর থেকে ফোন রিসিভ হচ্ছিলো না। কোথাও খোঁজ মিলছিল না আয়াতুল্লাহর।”

তিনি বলেন, “ছেলের সন্ধানে গ্রামের বাড়ী থেকে গাজীপুর ছুটে যাই আমি। ধর্না দেই আনসার একাডেমিতে। সন্ধান চাই ছেলের, জীবিত না থাকলে লাশটি অন্তত ফেরত পাওয়ার আকুতি জানাই। কিন্তু  কোনো সহযোগিতা পাইনি সেখান থেকে। ছুটে যাই একের পর এক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। লাশের স্তুপে খুঁজতে থাকি নিজের সন্তানকে। এরপর শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসি। ”

তিনি জানান, ঘটনার পর গাজিপুর জেলার কালিয়াকৈর থানায় ছোট ভাইয়ের সন্ধান চেয়ে বড় ভাই মোঃ সোহাগ মিয়া থানায় জিডি করে (জিডি নং ৩৭৫ তাং ১৬/৮/২০২৪ইং)।একটি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত খবরের সূত্রে ১১ দিন পর ১৬ আগস্ট  ঢাকার সোহরাওয়ার্দী  মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আয়াতুল্লাহর লাশের সন্ধান পায় তার পরিবার। সেখান থেকে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সহায়তায় ১৭ আগস্ট শনিবার বিকেলে হাসপাতাল থেকে লাশটি গ্রহণ করেন তিনি। 

ওইদিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে স্থানীয় উব্দাখালী নদীর ওপর নির্মাণাধীন সেতুর ওপর জানাজা শেষে রাত আড়াইটার দিকে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার চামারদানী ইউনিয়নের জলুষা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে আয়াতুল্লাহ’র লাশ দাফন করা হয়। ছেলের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আয়াতুল্লাহ’র পিতা সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আয়াতুল্লাহকে বড় আলেম বানানোর ইচ্ছে ছিলো। আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে তাদের বিচার চাই। খুনির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”

পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, আয়াতুল্লাহর পিতৃভিটা সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার চামারদানী ইউনিয়নের জলুষা গ্রামে। তার দাদা মরহুম আব্দুর রহীম কালারচান ফকির এলাকার একজন মরমী সাধক ছিলেন। এছাড়া ১৯৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বিত্তবান সালিশী ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি।

মো.আয়াতুল্লাহ’র জন্ম ২০০৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর গ্রামের বাড়ীতে।  মো. সিরাজুল ইসলাম ও মাতা শুভা আক্তার দম্পতির চার ছেলেমেয়ের মধ্যে আয়াতুল্লাহ সবচেয়ে ছোট। তিনি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক কলাবাঁধা এলাকাধীন দক্ষিণ ভান্নারাস্থ মারকাযুল ঈমান মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি নূরানী মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। সময় দিয়েছেন তাবলীগেও।

আরও পড়ুন: সেরা ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল তাহমিদের

দরিদ্র পরিবারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে এ বছর জুলাই মাসে খ-কালিন চাকুরিতে যোগ দেন গাজীপুরের এক ইন্ডাস্ট্রিতে। বড় ভাই সোহাগের সাথে কালিয়াকৈরের জামতলা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। পলাতক স্বৈরাচার সরকারকে রক্ষায় মারমুখী আনসার বাহিনীর গুলিতে তার সব স্বপ্ন রক্তের উজানে ভেসে গেছে।

আয়াতুল্লাহর পরিবারের সুত্রে জানা যায়, শহিদ মো.আয়াতুল্লাহ’র পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন,  নাগরিক আলেম সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ২১ আগস্ট মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের কক্ষে নিহত আয়াতুল্লাহর বাবা কৃষক মোঃ সিরাজুল ইসলামের কাছে মধ্যনগর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা বাবদ এক লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন মধ্যনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা  অতীশ দর্শী চাকমা।

এছাড়া গত  পহেলা সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে শহিদ আয়াতুল্লাহর পিতার সঙ্গে দেখা করে সহমর্মিতা ও সমবেদনা জানান নাগরিক আলেম সমাজের প্রধান সমন্বয়ক লেখক ও সাংবাদিক নোমান বিন আরমান, মিশন ওয়ান মিলিয়নের প্রধান নির্বাহী ফায়যুর রাহমান ও লেখক নাওয়াজ মারজান। এ সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়াতুল্লাহর পিতার হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া হয়।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) কে বলেন, ওই শহিদ পরিবারটি খুবই দরিদ্র হওয়ায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকেও ইতোমধ্যে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে এবং আরো সহায়তা দেয়া হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি দেওয়ান ইছকন্দর রাজা চৌধুরী সুবক্ত রাজা বলেন, মাদ্রাসা ছাত্র শহিদ আয়াতুল্লাহ আমাদের সুনামগঞ্জ জেলার গর্ব ও অহংকার। যতদিন এ জেলায় সুরমা, কালনী, কুশিয়ারা নদী প্রবাহিত থাকবে ততদিন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় এই মহান শহিদ সূর্য সন্তানকে আমরা স্মরণ করবো।

এদিকে আয়াতুল্লাহ’র স্মৃতিকে অমর করে রাখতে তার নামে সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে উব্দাখালী নদীর ওপর নবনির্মিত ৩২০ মিটার দীর্ঘ সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট বিকেলে উব্দাখালী নদীর ওপর নির্মিত সেতুর সামনের সড়কে শহীদ আয়াতুল্লাহর নামে সেতুর নামকরণ করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অতীশ দর্শী চাকমা, মধ্যনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ এমরান হোসেন, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম মজনু, মধ্যনগর বাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আবুল হাসান আখঞ্জি, শহীদ আয়াতুল্লাহ’র বাবা মো. সিরাজুল ইসলামসহ তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ।

সূত্র : বাসস


সর্বশেষ সংবাদ