ভালো নেই, কেবল বেঁচে আছেন শিক্ষকরা      

হাসিবুল ইসলাম (৩৭)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্সের পর উত্তীর্ণ হন ৮ম নিবন্ধন পরীক্ষায়। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি প্রভাষক যোগদান করেন কুষ্টিয়া পোড়াদাহ কলেজে। যোগদানের পর একবছর কোনো বেতন পাননি হাসিবুল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে তিন হাজার টাকা করে মাসিক বেতন পেতেন কলেজ প্রভাষক হাসিবুল।

এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে ফের বেতন বন্ধ হয়ে যায় তার। করোনা মহামারী চলাকালে অনলাইনে ক্লাস নিতেন এমপিওভূক্তির প্রত্যাশায় থাকা এ শিক্ষক। পরে এমপিওভুক্তি তো হয়নি, বরং করোনার আগে কলেজ থেকে যে তিন হাজার টাকা করে পেতেন সেটাও আর চালু হয়নি। বাধ্য হয়ে ২০২১ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান একবুক হতাশা নিয়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে চাকরি নেন একটি এনজিওতে। 

হাসিবুলের মতো পেশা বদলিয়েছেন অসংখ্য শিক্ষক। যারা বদলাতে পারছেন না তারা নিভৃতে কাঁদছেন ফুপিয়ে ফুপিয়ে। স্বল্প বেতনে এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

সরকারি মজুরি বোর্ডের গ্রেড-১৩-এর অধীনে প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষক মাসে বেতন পান মাত্র ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে, একজন প্রধান শিক্ষক পান মাত্র ১৯ হাজার টাকা। বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা মাসে সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পান, এই টাকার আবার ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয় অবসরকালীন সুবিধা জন্য। সরকার অবশ্য সর্বশেষ ২০২০ সালে বেতন বাড়িয়েছিল; তবে সেখানে ইনক্রিমেন্ট ছিল মোটামুটি ১ হাজার টাকার মতো।

আরও পড়ুন: প্রাথমিকে বেতন বৃদ্ধি: প্রতিমন্ত্রী-সচিবের বক্তব্য

এছাড়া, ব্যক্তি মালিকানাধিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের বেতনের অবস্থা আরও নাজুক। তরুণদের বেকারত্বকে পুঁজি করে ফায়দা লুটছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয় ৮-১০ হাজার টাকা। মফস্বলে এ অবস্থা আরও করুণ। 

প্রাথমিক শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির হলেও তারা বেতন পান ১১তম গ্রেডে। অথচ দ্বিতীয় শ্রেণির অন্য সব চাকরিজীবী দশম গ্রেডে বেতন পান। এমনকি ৩৪তম বিসিএস থেকে যখন দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হয় তখন সবাই দশম গ্রেড পেলেও শুধু সরকারি প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা পেয়েছেন ১১তম গ্রেড।

একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক রাকিব হাসান বলেন, শিক্ষকতা করে যে বেতন পাই তা দিয়ে মাসের প্রথম দশদিন পার করাই কঠিন। বেতনের টাকায় সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, সন্তানদের পড়ালেখার, চিকিৎসা ব্যয় মেটানো যায় না। দিন দিন বেঁচে থাকার লড়াই কঠিন হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় শিক্ষকতায় এসে ভুল করেছি।

এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) তালিকাভুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নূরুন্নবী সরকার বলেন, উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন পিয়নদের বেতনের তুলনায়ও কম। আমরা শিক্ষকরা এখনও দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। আমাদের সামাজিক মর্যাদা পর্যন্ত নেই। আমরা স্বচ্ছল নই। আমরা ক্ষুধার্ত থেকে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবো? সরকারের উচিত আমাদের প্রথম শ্রেণীর চাকরিজীবীদের মর্যাদা দেওয়া।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষকরা বহুদিন ধরে বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু  শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এভাবে চলতে থাকলে মেধাবিরা আর শিক্ষকতায় আসবে না। শিক্ষকদের অস্বচ্ছল রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কিংবা শিক্ষার মানোন্নয় কোনোটিই সম্ভব হবে না।

আরও পড়ুন: সরকারি কর্মচারীদের ৬০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেতনভাতা নিয়ে বেশি অসন্তোষ বিরাজ করছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা শিক্ষকদের মধ্যে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে এই শিক্ষকদের আয় না বাড়ায় তারা হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ছুটছেন বিকল্প আয়ের পেছনে। পরিবারের ব্যয় মেটাতে শিক্ষকদের কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য, কোচিং সেন্টার, মাছ চাষ, গরু পালন, পল্লী চিকিৎসা, সাংবাদিকতা, কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন ধরণের আর্থিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এসব কাজে ব্যয় হচ্ছে শিক্ষকদের মূল্যবান সময় ও শ্রম। এর প্রভাব পড়ছে শ্রেণীকক্ষে। শিক্ষক শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা শিক্ষার্থীতের জন্য আলাদা করে চিন্তা করার অবকাশ পাচ্ছেন না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একজন শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষের বাইরে অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে বের হওয়া দুঃখজনক। কিন্তু শিক্ষকদের এছাড়া কিছু করার নেই। দিনশেষে উচ্চ বেতনের একজন কর্মচারী যে টাকায় চাল-ডাল কেনেন, স্বল্প বেতনের একজন শিক্ষককেও একই হারে চাল-ডাল কিনতে হয়। 

তিনি বলেন, শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলে। কাজেই ভালো প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা যায় না।

সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়, এই মুহূর্তে বেতন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় সাম্প্রতিককালে ৩০০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এই মুহুর্তে বেতন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ২০২০ সালে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৪ থেকে ১৩ তে উন্নীত করা হয়েছে। কাজেই নিকট ভবিষ্যতে প্রাথমিক শিক্ষকদের আর বেতন বৃদ্ধি হবে না। আর গত ১০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন,  সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা প্রদানের কোনও পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, সহসাই বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে না শিক্ষকদের। তবে জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দ্রুতই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। 

আরও পড়ুন : চার দশক ধরে বেতনবঞ্চিত ইবতেদায়ী শিক্ষকরা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ আবদুল হালিম বলেন, বাংলাদেশে সব পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম। জীবন-যাত্রার ব্যয় মেটাতে শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য চিন্তা করতে হচ্ছে। এর ফলে তারা শিক্ষার মান উন্নয়নে বা নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে পুরোপুরি অবদান রাখতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশি। ভারত শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে কারণ তাদের শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল। আমাদের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা খুব বেশি নেই। এরপরও তারা শিক্ষকতা করছেন। মানুষ গড়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিষয়ে সরকার সম্যখ অবগত। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ব্যবস্থা করে সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া গেলে শিক্ষার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আশা করি  এ বিষয়ে সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মোঃ ফারুক আলম বলেন, দেশের চলমান অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নেই। 


সর্বশেষ সংবাদ