নিয়োগ পরীক্ষায় গলাকাটা ফি বেকারদের জন্য বাড়তি চাপ
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০১৯, ০৩:৪৬ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:৩৮ PM
বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও বেকার অধ্যুষিত দেশে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি আদায় যেন রীতিমতো নিয়ম মাফিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে সরকারি চাকরিতে যে পরিমাণ আবেদন পড়ছে তা কখনো কখনো বিশ্বের কিছু দেশের জনসংখ্যাকেও অতিক্রম করেছে৷ দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা থেকেও আমাদের দেশে চাকরির আবেদনকারী বেশি।
এবারে তো এনএসাইয়ের বিভিন্ন পদে রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থী আবেদন করেছে। আবেদনকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা বিপুল টাকা পরীক্ষার ফি বাবদ পেয়েছেন। এসব সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গুলো যেন একেকটা সরকারি রাজস্ব আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বেকার তরুণদের কষ্টে জমানো টাকা গুলো নিয়ে তারা অর্থের পাহাড় গড়ে তুলছেন। তারা কি জানেন এ অর্থে অসংখ্য বেকার তরুণদের অশ্রু জল মেশানো। কসাইয়ের মতো এ নির্দয় আচরণের শেষ কোথায়? একটুও বেকার তরুণদের জন্য কি অনুগ্রহ, মায়া জাগে না?
এমনিতে তো বেকারত্বের অভিশাপে তরুণরা জর্জরিত। সেখানে নিয়োগ পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো।
চাকরির জন্য নিয়মিত যারা আবেদন করেন, তাদের জন্য এটা এক ধরনের বাড়তি চাপ বৈকি। একই সাথে অতিরিক্ত ফি অনেক ক্ষেত্রে হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা মাত্র ৩০ বছর। শিক্ষা জীবনে সেশনজটের মতো কুফা তো রয়েছেই। অধিকন্তু প্রাইভেট, টিউশন করে কষ্ট করে অনেকে পড়াশোনা চালিয়ে নেয়, বাড়ি থেকে টাকা না নিয়ে।
সেখানে বেকার তরুণদের উপর বাড়তি পরীক্ষার ফির নামে জগদ্দল পাথর চাপিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ কি সুখানুভূতি পায়? তা আমার বোধগম্য নয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার ছিল ২০১০ সালে। সে হিসাবে ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২০ লাখ লোক বেকার ছিল। ২০১২ সালে ২৪ লাখ। ২০১৬ সালে ২৮ লাখ। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখে উঠার আশঙ্কা করছিল আইএলও।
তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী সারা দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস। অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ। এই শিক্ষিত বেকারদের চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত আবেদন করতে হচ্ছে আর এজন্য তাদের গুণতে হচ্ছে অতিরিক্ত পরীক্ষা বাবদ ফি।
সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে হলে বাংলাদেশে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে ৭০০ টাকা পর্যন্ত আবেদন ফি জমা দিতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দিতে হয় এর চেয়েও বেশি। অনেকে প্রতিমাসে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য একাধিক আবেদন করে থাকে ফলে প্রতি মাসেই চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বেকার জীবনে আবেদন ফির এতো টাকা তাদের জন্য বোঝা হয়ে যায়।
তাছাড়া চাকরির অধিকাংশ পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে যাতায়াতসহ অন্যান্য ব্যয় তো আছেই। অনেক দিন ধরে চাকরির পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠানের জন্য তরুণদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হচ্ছে কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কার কথা কে শোনে। অরণ্যে রোদনের মতো মনে হয়।
আজ যারা বড় বড় চেয়ার দখল করে বসে আছেন তাদের অধিকাংশের ভাবসাব দেখে মনে হয় তারা কখনো বেকার ছিলেন না। এজন্য বেকারদের কষ্টের আর্তি, আর্তনাদ তাদের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করে না। নরম চেয়ারে বসলে মেজাজ মর্জি বুঝি এরকমই হয়? জনমত জন আকাঙ্ক্ষা এভাবে পদদলিত করে নির্বিঘ্নে স্বপদে এদেশেই বহাল থাকা যায়, উপেক্ষা করা যায় যৌক্তিক দাবি। নির্লজ্জ বেশরম হলে যা হয়।
তবুও জনবান্ধব সিদ্ধান্ত নিতে তারা অপারগতা দেখায়। একটি প্রতিষ্ঠান ইচ্ছে করলে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পুরোপুরি ব্যয় বহন করতে পারে। তা না করে পরীক্ষার ফির চেয়ে বেশি হারে ফি আদায় করে বেকার তরুণদের হতাশায় নিমজ্জিত করা হচ্ছে। একটি পদের জন্য যেখানে শতশত পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে সেখানে এতো বেশি পরিমাণে ফি আদায় চরম গ্লানিকর ও বেকারদের সঙ্গে চরম তামাশার শামিল।
পরীক্ষায় প্রিলি রিটেন ভাইভাসহ প্রাথমিক ব্যয় আবেদনেই সকল পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয়। অথচ এ ফি পর্যায়ক্রমে আদায় করা যেতে পারে। রিটেন, প্রিলি, ভাইভার জন্য আলাদা ফি নিলে বেকার তরুণদের জন্য চাপটা অনেকাংশেই কমে যেত। কিংবা নূন্যতম ফি যা না নিলে নয়, তা নিয়ে বেকার তরুণের পরীক্ষার অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। চাকরির পরীক্ষায় আবেদনকারীদের কাছ থেকে পে-অর্ডার/চালান/পোস্টাল অর্ডার নেয়ার বিধান রয়েছে।
এক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে সুবিধা বঞ্চিত ব্যতীত সকল প্রার্থীর জন্য অফেরতযোগ্য ৭০০ এবং ১০০ টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৩-১৭ গ্রেডের পদে কর্মচারী নিয়োগের জন্য ১০০ টাকা এবং ১৮-২০ গ্রেডের পদে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে অফেরতযোগ্য ৫০ টাকা ফি নেয়া হয়ে থাকে। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে বেকার চাকরি প্রার্থীকে মোটা অঙ্কের ‘ফি’ দিতে হয়।
প্রায় সব প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির আবেদন ‘ফি’ অন্তত ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আবার কোনো কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘ফি’ নিয়ে থাকে। এই মোটা অঙ্কের ‘ফি’ লাখ লাখ বেকার চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে নেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? উন্নত দেশে যেখানে বেকারদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বেকারত্ব মোচনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বেকার তরুণদের বেকারত্ব দূরীকরণে বেকার ভাতা দেওয়া হয়।
অথচ বাংলাদেশে নিয়োগ পরীক্ষায় অতিরিক্ত ফি আদায় করে তরুণদের উপর স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। বেকার তরুণদের মনের দুঃখ কষ্ট গুলো বুঝে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালীন সময়ে আতিউর রহমানের পদক্ষেপে চাকরির আবেদনের জন্য কোনো প্রকার ফি না নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল।
সেক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারি ব্যাংক গুলো এখন ফ্রি নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে থাকে। কিন্তু অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন ফি ছাড়া পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা এখনো গ্রহণ করেনি। তরুণ যুবকদের দুশ্চিন্তা ও কষ্ট লাঘবে বিনা ফিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা এখন অতীব জরুরী।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘সহকারী শিক্ষক’ নিয়োগ পরীক্ষার আবেদন করেছিল ২৪ লাখ এক হাজার ৫৯৭ জন প্রার্থী। এ নিয়োগ পরীক্ষা বাবদ ১৬৮ টাকা ফি আদায় করা হয়। আবেদনে ৪০ কোটি ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৭৬ টাকা জমা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোষাগারে। গতবছরের মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষকের এক হাজার ৩৭৮ পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২ লাখ ৪৮ হাজার ৩২২ জন প্রার্থী। প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ফি বাবদ নেয়া হয়েছে ৫০০ টাকা।
এতে সরকারের আয় হয়েছে ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত বছর খাদ্য অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে ১ হাজার ১৬৬ পদের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছিল ১৩ লাখ ৭৮ হাজার।এই পরীক্ষায় আবেদন ফি ছিল ১১২ টাকা। সে হিসাবে আবেদন ফির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে ১৫ কোটি ৪৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
গত ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য দুই হাজার ২৪ শূন্যপদের বিপরীতে আবেদন করেছিল তিন লাখ ৮৯ হাজার জন। যার ফি ছিল ৭০০ টাকা। এর মাধ্যমে ২৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে বেকারদের পকেট থেকে। সর্বশেষ ৪০ তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী। গড়ে ৭০০ টাকা আবেদন ফি ধরলে পিএসসি বেকার তরুণদের কাছ থেকে আয় করেছে ২৮ কোটি ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৪০০ টাকা।
গত বছরের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৩৯ হাজার ৫৩৫ টি শূন্য পদে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। এতে উপরিউক্ত শূন্য পদের বিপরীতে প্রায় ৩১ লাখ আবেদন জমা পড়ে। ১৮০ টাকা আবেদন ফিতে এনটিআরসিএ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের এ আবেদন ফি থেকে প্রায় ৪৪ কোটি টাকা আয় করে। ৬ লাখ ৮০ হাজার প্রার্থী আবেদন করেছিল গড়ে প্রতি জনে ৭টি করে আবেদন জমা পড়েছিল।
এবছর এনএসআইতে কয়েকটি পদে নিয়োগ পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে। এতে ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৮৯ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। এবার হিসাব করে দেখেন এতে পরীক্ষা ফি বাবদ কত টাকা তারা পেয়েছে? অথচ পরীক্ষার ফি বাবদ যা আদায় করা হয় তার চেয়েও পরীক্ষা গ্রহণ থেকে নিয়োগ পর্যন্ত ব্যয় হয় যৎসামান্য। বেকারদের ভোগান্তি কমানোর চেয়ে বেকারত্ব বাড়ানোই তারা বেশি সক্রিয়।
একদিকে বেকারত্বের অভিশাপ, অন্যদিকে আবেদন ফির নামে অতিরিক্ত টাকার জোগান দেয়া তরুণদের জন্য খুবই কষ্টের। ফলে হতাশা বিরাজ করে বেকার তরুণদের মধ্যে। ব্যাংকের মতো সরকারি বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ কার্যক্রমে যদি ফি নেয়া বন্ধ হয় তাহলে অন্যান্য চাকরি পরীক্ষায় ফি ছাড়া নিতে আপত্তি কেন? অথবা নামে মাত্র ফি নিয়ে আবেদন করার সুযোগ দিতে সমস্যা কোথায়?
পরিশেষে বলি সবাই একসময় বেকারত্বের সোপান মাড়িয়ে তার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায় পৌঁছেছে। সুতরাং বেকারত্বের কষ্ট ও আর্থিক দীনতা তাদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়।চাকরির পরীক্ষায় আবেদন ফি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বেকার তরুণদের অতিরিক্ত টেনশন হতাশা ও কষ্ট থেকে মুক্তি দিন।
[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]