মা আমার পরম বন্ধু
- নাবিলা বিনতে হারুন
- প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ০১:০৪ PM , আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫, ১২:১৬ AM

‘দুঃখ এলেই মাকে ডাকি, কষ্ট হলে বুক ভার; মা-ই শুধু বুঝতে পারেন, কোথায় আমার আঁধার’ বলা হয়ে থাকে, পরিবারের বড় মেয়ে মায়ের কাছে বন্ধুর মতো। বাবার চাকরির সুবাদে প্রথমবারের মতো মায়ের নারায়ণগঞ্জ আসা। এর আগে ঢাকায় থেকেছেন। তবে বড় হয়েছেন গ্রামে। বাইশ বছর বয়সে যখন অজানা এক শহরে, অচেনা মানুষের ভিড়ে মা হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখনই মায়ের সঙ্গী হই আমি। ছোট্ট নাবিলা। ছোট ছোট হাতের ছোট্ট ছোট্ট আঙুলে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে বড় হই। মাও বড় হন আমার সাথে।
মায়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়ায় তার সব দুঃখ-সুখের সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার মনে আছে খুব ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে আমি যখন স্কুলে যেতাম। আমার মায়েরই এক বান্ধবী আমাদের শ্রেণি শিক্ষক ছিল। মা প্রতিদিন আমাকে তাঁর হাতে সোপর্দ করে দিয়ে মাঝেমধ্যেই স্কুল শিক্ষক বান্ধবীর সাথে গল্পে গল্পে ফিরে যেতেন অতীত স্মৃতি চারণায়। শুনতেন তাঁর স্কুল শিক্ষক হওয়ার পেছনের গল্পটা। শুনতেন সংসার সামলিয়েও কীভাবে শিক্ষকতা করছেন তার গল্প। ফেরার পথে যখন আমি মায়ের হাত দোলাতে দোলাতে চকলেট খাওয়ায় ব্যস্ত, তখন বহুবার মাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুনেছি, ইশ! যদি বিএটা সম্পন্ন করতে পারতাম, তাহলে হয়ত আমিও এমন একটা স্কুলে শিক্ষক হতে পারতাম। ছোট্ট আমি বুঝিনি তখন ঠিক কী কারণে এমনটা কঠিন ছিল।
তারপর আমি আরেকটু বড় হলাম। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিয়েছি। মা প্রতিদিন নিয়ম করে আমার জন্যে টিফিন নিয়ে যেতেন। টিফিনের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হতো আধাঘণ্টা। আমাদের লক্ষ্য থাকতো যতদ্রুত খাবারের ল্যাঠা চুকিয়ে মাঠে নেমে পড়া যায়। মাঠের এমাথা থেকে ওমাথা হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে যখন ছুটে বেড়াতাম, মা পুরো সময় মাঠের মাঝখানটায় দাঁড়ানো আম গাছটার নিচে বসে বসে দেখতেন আর হাসতেন। হাসির সাথে কখনো কখনো সাবধান বাণীও শোনা যেত। পড়ে ব্যথা যেন না পাই তার সাবধান বাণী। কিন্তু মা কখনো আমায় থামতে বলেন নি।
এরপর উচ্চমাধ্যমিক। মায়ের আঁচল ছেড়ে বের হওয়ার পালা। কৈশোরের শেষে নিজের চেনা শহরও যেন কত রঙে রঙিন দেখাচ্ছিল। কত ভুল করেছি তার হিসেব রাখা হয়নি। মা দেখেছেন, শুনেছেন, শিখিয়েছেন। আগুনের সমস্ত তাপ নিজের শরীরে নিয়ে আমাকে গড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, স্বাধীনতা দিয়েছেন।
আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে ছুটে বেড়াই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বন্ধুর পথচলায় মা ছিলেন আমার সর্বক্ষণের সাথী। আমার বেছে নেয়া পথ যত কঠিনই হোক না কেন, মা আমাকে থামাননি। বিপদসংকুল পথে আমার সঙ্গী হয়েছেন। কর্তৃত্ব দেখিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াননি। লক্ষ্যে স্থির থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আঁধারের পরেই আলোর দ্যুতি নিয়ে ছুটে এসেছেন প্রতিবার।
বয়স আমার একুশ হতে চলল। নির্ভার আমি মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াই আকাশজুড়ে। এই পৃথিবী আমাকে থামাতে পারেনি। কারণ মা ছিলেন আমার সঙ্গে। ধরণীর সব বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে আমাকে মুক্ত করেছেন। মাঝে মাঝে অবাক চোখে তাকিয়ে মাকে দেখি আর ভাবি এ কারণেই কি তবে নিজের স্বপ্নগুলোর নোঙর করেননি? আমার স্বপ্নগুলো বুনেছেন নিজের করে?
বিকেলে যখন মায়ের সাথে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে হেঁটে বেড়াই, তখন স্রষ্টার কাছে একটাই প্রার্থনা থাকে আমার, খোদা এই দুনিয়ার শেষ যেন না হয়। আমি আর মা যেন এভাবেই হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়াই অনন্তকাল। শীতলক্ষ্যার পানিও প্রতিবার পাড়ে বালি ছড়িয়ে দিয়ে যেন আমারই প্রার্থনায় সায় দিয়ে যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়