যে কারণে সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো উচিত মনে করি

মোজাফ্ফর হোসেন
মোজাফ্ফর হোসেন  © টিডিসি সম্পাদিত

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনে বড়ো হয়েছি। ফলে সন্তানদের বাংলা মিডিয়ামে পড়ানো নিয়ে আমার মধ্যে গোঁড়ামি ছিল। কিন্তু নিজের দুই ছেলেকে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় মিডিয়ামে পড়ানোর পর প্র্যাকটিকাল কিছু অভিজ্ঞতা হলো। এখন আমি মনে করি, সামর্থ্য যাদের আছে, তাদের উচিত সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো। ইংরেজি মাধ্যম বাংলা মাধ্যমের চেয়ে বেটার, এমন কোনো হিসাব থেকে আমি বলছি না। আমি এখনো বিশ্বাস করি, শিক্ষা মাতৃভাষায় হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটা চলে না। কারণ, বাংলা মাধ্যমে বাচ্চাদের রাজনৈতিক গিনিপিগ হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিটা সরকার। যখন যে সরকার আসবে সেই সরকার সিলেবাসে হাত দেবে, টেক্সট বদলাবে। আমার ছেলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত এক রকম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ল, এখন আরেক রকম পড়ছে, আবার বিএনপি ক্ষমতা আসলে অন্যরকম পড়বে। এ বছর যে নায়ক, আরেক বছর সে ভিলেন। এই পরিবর্তন শুধু মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে না, জাতীয় ইতিহাস থেকে শুরু করে সাহিত্যের টেক্সট পর্যন্ত সবখানে। গত বছর এক উন্নয়নের গল্প, এ বছর আরেক উন্নয়নের গল্প। পরিবর্তন আসে সামাজিক রীতিনীতি ও অনুষঙ্গেও। ধরুন, একটা জায়গায় ছিল, ছেলেশিশু মাকে সাহায্য করছে ঘরের কাজে, মেয়েশিশু বাবার সঙ্গে বাজারে গেছে। এখন করা হলো উল্টোটা। মুসলমান সমাজে মেয়েশিশু কেন বাজারে যাবে? এই প্রশ্ন থেকে একটা পক্ষ পরিবর্তন করে দিলো। আরেকটা পক্ষ এসে মনে করল, মেয়েশিশু আর ছেলেশিশুর কাজএক্সচেঞ্জের মধ্য পরস্পরের কাজ সম্পর্কে ধারণা পাক। অথবা কাজের কোনো জেন্ডার থাকা উচিত না। এখন কোন পক্ষ ঠিক-বেঠিক, সেটা আমার আলোচনার বিষয় না। জনগণ হিসেবে আমার কথার যেহেতু মূল্য নেই, আমি কোনো মতামত দিচ্ছি না, আপনারাই ঠিক করে নেন, আমার সন্তানকে কোনটা পড়াবেন। আপনারা ঘুষ খাওয়ার সময় তো বলেন না, অমুক দল ঘুষ খায় আমরা খাবো না, আগের দল দুর্নীতি করত, আমরা করব না। দুর্নীতি-ঘুষে যদি নীতির বদল না হয়, বাচ্চাদের পাঠ্যপুস্তকে কেন?

গত পঞ্চাশ বছরেও এই জাতির একটা একক সমন্বিত শিক্ষানীতি দাঁড়ায়নি, আগামীতেও দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণ নেই। যেহেতু এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই, কাজেই যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের উচিত সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে না পড়ানো।  বছর বছর নীতি পবির্তনের কোনো ঝামেলা ইংরেজি মাধ্যমে নেই। সিলেবাস পরিবর্তন আর বেসিক নীতি পরিবর্তন, দুটো কিন্তু আলাদা বিষয়। প্রয়োজনে সিলেবাস আপডেট করা আর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিগত পরিবর্তন করা, ইতিহাস বদলে ফেলা এক বিষয় না।

আমি নিজে যেহেতু ছেলেকে বাংলা মিডিয়ামে পড়াচ্ছি, তাই একটা কথা সব রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, আমার সন্তান আপনাদের ভোটার না। কোনো দলেরই ভোটার না। ওর বয়স মাত্র ১১ বছর। অবশ্য ভোটার হলেও অসুবিধা ছিল না, ভোটের রাজনীতি এদেশে খুব একটা চলেও না। আমি নিজে জীবনে একবারও ভোট দিইনি। আমার চল্লিশ বছরের জীবনে গ্রাম, থানা, জেলা, বা জাতীয় কোনো পর্যায়ে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। আগামীতেও হবে না। কারণ আমি ভোট দিতে চাই অন্তত একজন সৎ লোককে, সেই নিশ্চয়তা এই মরার দেশে কখনোই পাবো না। আমার ভোট দেওয়া না দেওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু আসেও যায় না, তাই মূল কথায় আসি। কাজ হবে না, তবু অনুরোধটা করি, আপনাদের রাজনৈতিক বিদ্বেষ, রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে আমাদের সন্তানদের দয়া করে মাফ করে দেন। এমন একটা পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেন যেন কোনো দলকেই এসে হাত দিতে না হয়, অন্তত রাজনৈতিক কারণে। বাকি সব কিছু ওলটপালট করে দেন, ভাগবাটোয়ারা করে নেন দেশটা, শুধু শিশুদের মাফ করে দেন। সব শাসকের কাছেই এটা অনুরোধ। নিজের সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ালে এই অনুরোধ করতাম না। আমাদের অনুরোধে অবশ্য কাজ হবে না, তাই আপনাদের অনুরোধ করবো সামর্থ্য যাদের আছে সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ান। মিথ্যা আবেগ দিয়ে সন্তানের জীবন নষ্ট কইরেন না, কারণ আপনার আবেগ নিয়ে অন্যরা রাজনীতি করবে। যারা রাজনীতিটা করে শিশুদের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে, তারা কিন্তু নিজেদের বেলায় ভুলটা করে না, ঠিকই নিজের সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ায়।

ইংরেজি মিডিয়ামের পক্ষে আরেকটু ওকালতি করি, আমি মনে করতাম, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে বাঙালি/বাংলাদেশি সংস্কৃতির পাঠ হয় না। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাংলা মিডিয়াম স্কুলের চেয়ে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলোকে বাঙালি/বাংলাদেশি নানা উৎসব পার্বণ বেশি ঘটা করে উদযাপন করা হয়। অবশ্য, বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েও যখন জাতীয় পর্যায়ে সব দল এক হতে পারল না, তখন না শেখালেইবা কি। আর দেশের যা অবস্থা, তাতে নিজের সন্তান যদি বড়ো হয়ে পাড় ধান্দাবাজ এবং অন্ধ সাম্প্রদায়িক না হয়, তাতে তাকে বিদেশে পাঠানোর অপশনটা এখনই মাথায় রাখা ভালো। এক্ষেত্রেও ইংরেজি মাধ্যম সহায়ক হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence