নুনগোলা স্কুলের প্লাটিনাম জয়ন্তীতে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

এমরান কবির
এমরান কবির  © টিডিসি সম্পাদিত

বগুড়া তথা উত্তরাঞ্চলের পুরোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম নুনগোলা উচ্চ বিদ্যালয়। সদর থানার অন্তর্গত স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। পঞ্চাশের দশকের আগে-পরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা সহজ ছিল না। কিছু স্বপ্ন-সন্ধানী আলোকিত মানুষ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য এই কঠিন কাজটি সম্পন্ন করতে ব্রতী হয়েছিলেন। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি পঁচাত্তর বছরে পদার্পণ করল।

বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নিভৃত পল্লীতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার নানারকম প্রতিবন্ধকতা ছিল। স্কুলের জায়গা, শিক্ষক ও ছাত্র প্রাপ্তি, সরকারি অনুমোদন ছাড়াও ছিল আর্থিক সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা। স্বপ্ন-সন্ধানী মানুষেরা যখন স্বপ্নের পেছনে ছোটে তখন তা আর অসাধ্য থাকে না। এখানেও তাই হয়েছিল। নুনগোলা স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র (৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি-১৯৫০ এবং মেট্রিকুলেশন-১৯৫৫) জনাব সৈয়দুজ্জামান তালুকদার তারা এবং একই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রধান শিক্ষক জনাব মো. আকরাম হোসেন স্যার-এর স্মৃতিচারণা থেকে সেইসব বিদ্যোৎসাহী স্বপ্নবানদের সম্বন্ধে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মিয়াজান আলী প্রামাণিক, রশিয়তুল্বা প্রামানিক, রহমতুল্বা সরকার, ইসমাইল উদ্দিন তালুকদার, বাচ্চা মিয়া তালুকদার প্রমুখ এবং অত্র এলাকার জনগণ। সীমিত সামর্থের মধ্যে তাঁরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। প্রতিসপ্তায় মুষ্টি চাল সংগ্রহ করা হতো, ধানের সময় ধান সংগ্রহ করা হতো, যাদের বাঁশ আছে তারা বাঁশ দিয়ে সহযোগিতা করতেন। সপ্তাহে দুইদিন হাট বসত। সেখানে গোহাটি থেকে প্রতিটি বিক্রীত গরুর বিপরীতে দুই আনা করে সংগ্রহ করে স্কুলের ফান্ডে জমা হতো। প্রথম ব্যাচের ছাত্র জনাব সৈয়দুজ্জামান তালুকদার তারার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় এই কাজে তাঁর সাথে ছিলেন দশটিকা গ্রামের ইউনুছ এবং নুনগোলা পাড়ার রমজান আলী আম্বো। এভাবে তিলে তিলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজ নুনগোলা স্কুল দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত হয়েছে।

প্রথম ব্যাচের ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ-বারো জন আর শিক্ষক ছিলেন চার জন। স্কুলের বর্তমান  প্রধান শিক্ষক জনাব আবিদ হাসান সাহেবের দেয়া তথ্যমতে এখন নুনগোলা স্কুলের ছাত্র সংখ্যা পাঁচ শতাধিক আর শিক্ষক চৌদ্দ জন। শুরুর পর আজ নুনগোলা স্কুল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই সংখ্যা থেকে তার কিছুটা অনুমান করা যায়। বাংলাদেশের অসংখ্য কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাঁরা একসময় নুনগোলা স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন।

নুনগোলা স্কুলের আগে পরে বেশ কয়েকটি শিক্ষালয়ে (একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ) শিক্ষা গ্রহণ করলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি এই স্কুলের প্রতি বিশেষ দুর্বল। আর মনে মনে আমি এখনও নুনগোলা স্কুলেরই ছাত্র। যদিও বাস্তবে তা হবার নয়। নুনগোলা স্কুল আমার জীবনে এসেছিল বাস্তবতা ও পরাবান্তবতার মিথস্ক্রিয়ায় জন্ম নেয়া এক বিশেষ প্রপঞ্চরূপে। 

এর প্রধান কারণ বোধকরি আমাদের শিক্ষকগণ। আমরা সত্যিকার অর্থেই একঝাঁক নক্ষত্রপ্রতীম শিক্ষককে পেয়েছিলাম। যাঁদের দেখানো আলোয় এখনও পথ চলি। তিন দশক চলছে আমি এই স্কুলের প্রাক্তন হয়ে গেছি। কিন্তু এখনো চোখ বুঁজলেই কানে ভেসে আসে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কণ্ঠ। এখনো চোখ বুঁজলেই স্পষ্ট দেখতে পাই ফিজিক্যাল স্যার (আয়েজ উদ্দিন সরকার স্যার) ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন, হামিদ স্যার মুঘল স¤্রাজ্যের ইতিহাস পড়াচ্ছেন, কাদের স্যার চমকপ্রদ উদাহরণ আর হাস্যরস দিয়ে জীববিজ্ঞান আর ভূগোল পড়াচ্ছেন, আজিজ স্যার বিজ্ঞানের উদাহরণগুলো কত-না সহজভাবে বুঝাচ্ছেন, মমতাজ স্যার জ্যামিতির কঠিন সূত্রগুলো কত-না সহজভাবে বুঝাচ্ছেন, রফিক স্যার ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি আমাদেরকে যুক্তিশীলতা শেখাচ্ছেন, আলিয়া ম্যাডাম বাংলা পড়াচ্ছেন। মৌলভি স্যারের কাছে (মোবারক হোসেন স্যার) যে ধর্মশিক্ষা পেয়েছি তা সিলেবাসে সীমাবদ্ধ নয়, জীবনব্যাপী ধারণ ও পালনের এক উৎকৃষ্ট ধর্মবোধে উৎকীর্ণ। ইংরেজির মতো এক ভীতিজনক বিষয়কে হ্যাড স্যার (আকরাম স্যার) কত-না আনন্দময় করে তুলতেন। আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী আর পাঠমনোযোগী করার জন্য তিনি নানা ধরনের কৌশল ও পদ্ধতি প্রয়োগ করতেন। আর করে তুলতেন আত্মবিশ্বাসী। আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ ছিলেন এমন আলোকদ্যুতিময়, দূরদর্শী, অগ্রগামী আর আধুনিক।

প্রতি সপ্তাহে ফুটবল খেলা হতো অনেকটা বর্তমানের ইউরোপীয় লীগের মতো। বৃক্ষরোপন সপ্তাহের আয়োজন থাকত তার সাথে রচনা প্রতিযোগিতা, ফল উৎসব হতো। আর জাতীয় উৎসবের আয়োজন তো থাকতোই। নুনগোলা স্কুলে লাইব্রেরি ছিল। বইগুলো আমাদের কাছে মনিমুক্তোর মতো মূল্যবান। বুঝে না-বুঝে ওই বয়সেই পড়ে ফেলেছিলাম বিশ^সাহিত্যের অনেক ধ্রুপদী বই।

নুনগোলা স্কুল আমার অনেক কিছু। আমার শৈশব, শিক্ষা জীবন ও লেখক জীবনের প্রবল প্রভাব বিস্তারি নিয়ামক, শিক্ষকগণ আমার কাছে চিরসবুজ নায়ক। যদি কখনো জীবনের পেছনে ফেরার সুযোগ থাকে, আমি চাইবো নুনগোলা স্কুলের একজন শিক্ষার্থী হতে। যেখানে মাটির তৈরি ঘর থাকবে তার উপর থাকবে টিনের ছাউনি, বৃষ্টির দিনের আনন্দ থাকবে, গ্রীষ্মের দিনে মর্নিং ক্লাশ নেয়ার জন্য অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় থাকবে, প্রেমে পড়ে বা না-পড়ে কারো জন্য বুকের ভেতর জ্বালা থাকবে, অমুক প্লাস অমুক-এর যোগ মেলানোর গল্প থাকবে, আবার তা মেলাতে না পেরে ওই যোগের ওপর বীজগণিতের সূত্র প্রয়োগের সৃজনশীলতা থাকবে, তুই ওর দিকে তাকালি কেন—এরকম অজুহাত দিয়ে প্রেয়সীর উপর একচ্ছত্র প্রেমের প্রকাশ হিসেবে বন্ধুদের মধ্যে রেষারেষি থাকবে। অথচ কথিত প্রেয়সী জানবেই না তাকে নিয়ে ঘটে যাচ্ছে এত কিছু, জানালা দিয়ে তাকালে সবুজ গাছ দেখা যাবে, আর দেখা যাবে সবুজ গাছের চেয়েও চিরসবুজ আমাদের শিক্ষকগণের উপস্থিতি। 

একদল উদ্যমী মানুষের নেতৃত্বে ঈদের তৃতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্লাটিনাম জয়ন্তী উৎসব। সেখানে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী (মাত্র একজন জীবিত) থেকে শেষ ব্যাচের শিক্ষার্থীও অংশগ্রহণ করবেন। স্মৃতিতে স্মৃতিতে ভরে উঠবে প্রিয় প্রাঙ্গণ।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক


সর্বশেষ সংবাদ