সুন্দরবন দিবস: জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা
- তানজিদ শুভ্র
- প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৫২ PM , আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৫ PM

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, যা বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এটি শুধু একটি বন নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক আশীর্বাদ, যা আমাদের জলবায়ু, অর্থনীতি এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করে। ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশে প্রায় ৬০ শতাংশ সুন্দরবন অবস্থিত। ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের ১,৩৯,৭০০ হেক্টর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকাকে ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তন, বন নিধন ও দুষ্কৃতিকারীদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের কারণে এই বিশ্ব ঐতিহ্য হুমকির সম্মুখীন। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
সুন্দরবনকে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ কারণ এটি উপকূলীয় এলাকা রক্ষা করে এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন শোষণ করে পরিবেশকে সুস্থ রাখে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০২০ সালের আমফান-এর মতো দুর্যোগের সময় সুন্দরবন তার গাছপালা দিয়ে ঝড়ের গতিবেগ কমিয়ে আমাদের উপকূল রক্ষা করেছে। এটি না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হতো।
সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ২৬০ প্রজাতির পাখি, ৩১৫ প্রজাতির মাছ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ। এছাড়া রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মিঠা পানির কুমির, হরিণ, বন্য শূকরসহ অনেক বিরল প্রাণীর আবাসস্থল এটি। সুন্দরবন থেকে মধু, মাছ, কাঠ, চিংড়ি, গোলপাতা সংগ্রহ করে লাখো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া, প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
সুন্দরবনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য হলেও নানা হুমকির মুখে এটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে গাছ কাটা, শিল্প স্থাপনা এবং বসতি সম্প্রসারণের কারণে সুন্দরবনের আয়তন কমছে। গবেষণা বলছে, গত কয়েক দশকে সুন্দরবনের প্রায় ১৭% এলাকা হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে সুন্দরবনের অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নদীতে প্লাস্টিক ও রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার ফলে প্রাণীরা ধ্বংস হচ্ছে। আবার রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অনেক বিরল প্রজাতির প্রাণী শিকারিদের হাতে পড়ছে, যা সুন্দরবনের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ‘সুন্দরবন দিবস’ পালিত হলেও নানা অবহেলায় এখনো তেমন গুরুত্ব পায় নি। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন’। সুন্দরবন রক্ষার জন্য আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
অবৈধ শিকার ও বৃক্ষনিধন কঠোরভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে হবে। বনসম্পদ লুণ্ঠন বন্ধে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। স্থানীয় জেলেদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা অবৈধভাবে বন নিধনে না জড়ায়। যত্রতত্র নৌযান চলাচল ও প্লাস্টিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা চালু করে বন সংরক্ষণ নিশ্চিত করা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে গাছ লাগানোর মতো কার্যক্রম বাড়ানো। পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বনভূমি। এটি রক্ষা করা শুধু সরকারি বা সংস্থার কাজ নয়, আমাদের সবার দায়িত্ব। দিবসকেন্দ্রিক একদিনের কর্মসূচি যথেষ্ট নয়, বরং সারাবছর ধরে সচেতনতা বাড়ানো এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ‘সুন্দরবন বাঁচলে, দেশ বাঁচবে’—এই কথাটি মেনে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।