সরকারের অথর্ব প্রশাসনের একটি উদাহরণ- মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা
- রাজীব আহাম্মদ
- প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩০ AM , আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৪০ AM

সরকার যে কত অথর্ব প্রশাসন দিয়ে চলছে, এর একটি উদাহরণ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। গত ২৬ নভেম্বর মেডিকেল এবং ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ২০২৫ সালের নীতিমালা প্রকাশ করেছে।
এর ৯.১.১ ধারায় বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত বছরের ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ভর্তি পরীক্ষায় ৫ শতাংশ আসন মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অথচ ২৩ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপনে সাদা বাংলায় লেখা রয়েছে, কোটা শুধুমাত্র চাকরির জন্য প্রযোজ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য এ প্রজ্ঞাপন প্রযোজ্য, এমন একটি বর্ণও নেই।
আর পড়ুন: মেডিকেলে প্রথম হবো স্বপ্নেও ভাবিনি: সুশোভন বাছাড়
আপনাদের হয়ত মনে আছে, সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে আদালতের রায়ের প্রতিবাদেই গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়। গত ২১ জুলাই আপিল রায় দেন, সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ ৫ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ ভাগ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ ভাগ কোটা থাকবে।
এরই ধারবাহিকতায় ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন। বিএমডিসির ২০২৫ সালের ভর্তি নীতিমালায় এ প্রজ্ঞাপনের স্মারক নম্বর দিয়ে ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ করেছে! দফায় দফায় মিটিং করে নীতিমালা করলেও, তাদের চোখে পড়েনি প্রজ্ঞাপনটি শুধুমাত্র চাকরি জন্য প্রযোজ্য।
কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া কোটা রেখেছে। যদি জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনই মান্য করা হয়, তাহলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের ২ শতাংশ কোটা কই? সরকারি মেডিকেল ডেন্টালে ৫৩৮০ আসনে তো ২ শতাংশ হিসাবে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১০৮টি আসন সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু রয়েছে মাত্র ৩৯টি।
আরও আজব বিষয়, নীতিমালায় বিএমডিসির রেজিস্ট্রার ডা. লিয়াকত হোসেনের সই থাকলেও তিনি এখন বলছেন, চাকরির কোটা ভর্তিতে কীভাবে এলো জানেন না। কারণ তিনি মিটিংয়ে ছিলেন না।
তাহলে কোথা থেকে এলো মুক্তিযোদ্ধা কোটা? খুঁজে পাওয়া গেলো, গত বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি নাতনিদের জন্য ২ শতাংশ কোটা ছিল। তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করতে গত বছর রিট করেন 'বিখ্যাত' অহিদুল ইসলাম তুষার। তিনিই চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের বহুল আলোচিত রিটটি করেছিলেন।
আরও পড়ুন: মেডিকেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্স প্রাপ্তদের তথ্য যাচাই ২৯ জানুয়ারির মধ্যে
সেই তুষারের রিটে গত ১ ফেব্রুয়ারি বিচারক মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারক মো.আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করে। সবাই জানেন, আওয়ামী লীগ আমলে আদালত এই জাতীয় রিটে চোখ বন্ধ করে রায় দিত। যেমন দিয়েছিল চাকরির কোটা পুনর্বহালে।
প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্ট এত বড় পটপরিবর্তনের পরও বিএমডিসি কেনো আপিল করেনি? কোটা বিরুদ্ধে এত কিছুর পরও বিএমডিসি কীসের আশায় বসে ছিল? কিছু তো করল না, উল্টো ভর্তি নীতিমালায় করেছে ভুল। আদালতের রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের কথা বললে কিছুটা হলেও শুদ্ধ হতো নীতিমালা। কিন্তু তা না করে প্রজ্ঞাপনের দোহাই দিয়ে নাতি নাতনিদের কোটা উঠে তুলে দিয়েছে বিএমডিসি। অথচ ১ ফেব্রুয়ারির রায়ে নাতি নাতনির কোটা ছিল। সবমিলিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়েছে আমলারা। একবার পড়েও দেখেনি, কী করেছে।
বিএমডিসি না হয় আপিল করেনি, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় কী করেছে? এ প্রশ্নেরও জবাব জরুরি।
আরও পড়ুন: মেডিকেল ভর্তিতে সমতল কোটায় আবেদনকৃতদের ফল স্থগিত
দেশের ৫৭টি সরকারি মেডিকেল এবং ডেন্টাল কলেজে ৫ হাজার ৩৮০ আসনের ৫ শতাংশ তথা ২৬৯টি সংরক্ষিত ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। জেনে অবাক হবেন, আবেদনকারী ছিল মাত্র ৬৮৬ জন। নাতি নাতনি কোটা না থাকায় আবেদনকারী এতকম। আমার ধারণা এর মধ্যে প্রচুর ভুয়া আছে। তবে বিএমডিসির হিসাব ধরলেও, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রতি আসনের বিপরীতে প্রার্থী আড়াই জন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পার্বত্য এলাকার ৩৯টি আসনের বিপরীতে সাড়ে ১১শ’ আবেদনকারী ছিলেন। প্রতি বিপরীতে ২৯ জন।
সার্বিকভাবে ৫৩৮০ আসনের বিপরীতে পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৫৩ জন। প্রতি আসনের বিপরীতে ছিলেন ২৫ দশমিক ১৪ জন। এবার চিন্তা করুন, কী পরিমাণ বৈষম্য হয়েছে। কোথায় ২৫.১৪ আর কোথায় ২.৫৫! তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। পাস নম্বর ৪০ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীরা চান্স পেয়েছেন। অন্যরা ৭০-৭২ পেয়েও পায়নি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মাত্র ১৯১ জন পাস করেছে। বাকিরা ফেল করায় কোটার ৭৮টি আসন শূন্য! এই বৈষম্য আর কতদিন? এ জবাব খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে অথর্ব প্রশাসন এবং আপিল না করায় দায়ীদের বিচার করেন ইউনূস সাহেব। ছাত্ররা আর কত প্রতিবাদ করবে?
লেখক: সংবাদকর্মী