ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব, উত্তরণের কৌশল

ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ
ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ   © টিডিসি সম্পাদিত

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গভীরে রয়েছে ইতিহাসের শিকড়, মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুত্ব, এবং ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য। কিন্তু এই মজবুত ভিত্তি সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্ক প্রায়শই পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অভাব কেবল কূটনৈতিক পরিসরে নয়, বরং দুই দেশের জনগণের মনোজগতে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বাসের অভাব দূর করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উভয় দেশ কীভাবে সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজে পেতে পারে, তা নিয়ে এই বিশ্লেষণ।

বিশ্বাসের অভাবের মূল কারণসমূহ মধ্যে তিস্তা চুক্তির অমীমাংসিত অবস্থান। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি আশা করলেও, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতা এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহা হতাশা তৈরি করেছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি, যা বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারতের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এছাড়াও সীমান্ত হত্যা যেমন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (BSF) হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। গত কয়েক বছরে সীমান্তে বহু বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, যা বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক অসমতা যেমন ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যের ভারসাম্য ভারতে বেশি ঝুঁকে রয়েছে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা ভারতের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কম, অথচ ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে দখলদারি করছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ অনেক পুরোনো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট বা নির্বাচনের সময় ভারতের ভূমিকা নিয়ে সবসময় প্রশ্ন উঠেছে। 

কারণ বাংলাদেশের ২০১৪, ২০১৮, এবং ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে ভারতের সমর্থন বিরোধীদের মতে, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে এবং আওয়ামী লীগকে এককভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।

২০১৮ সালেও ভারতের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক এবং কূটনৈতিক সমর্থন বিরোধীদের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ২০২৪ সালে ভারতীয় কূটনীতিকদের সফর এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক বিরোধী শিবিরের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। ভারতের এই ভূমিকা বারবার তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস বাড়িয়েছে।

বিশ্বাস পুনর্গঠনে ভারতকে আরো কৌশলী হতে হবে এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখতে হবে যেমন তিস্তা চুক্তি বা অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানে ভারতকে আন্তরিক হতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরির জন্য প্রতিশ্রুতি রক্ষা জরুরি। কৌশল হিসাবে তারা তিস্তা চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে জলবণ্টন ইস্যুতে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারে।

অন্যদিকে সীমান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে কঠোর নীতি গ্রহণ করা উচিত। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। কৌশল হিসাবে তারা সীমান্তে যৌথ মনিটরিং সিস্টেম গঠন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। 

এছাড়াও বাণিজ্য ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক এবং অশুল্ক বাধা দূর করতে ভারতকে উদার মনোভাব দেখাতে হবে। কৌশল হিসেবে বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা এবং বাংলাদেশি পণ্যের জন্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করা।

এছাড়াও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ পরিহার করতে হবে। ভারতের উচিত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা। একটি নিরপেক্ষ ও সহমর্মিতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করলে আস্থা বৃদ্ধি পাবে। যেমন রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতা না করে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা এবং বাংলাদেশকে নিজস্ব সমস্যার সমাধান করতে স্বাধীনতা দেওয়া। 

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত বিনিময় বৃদ্ধি করা জরুরি যেমন দুই দেশের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত বিনিময় বাড়ানো আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে। অর্থাৎ কৌশল হিসাবে দুই দেশের মধ্যে যৌথ সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিনিময় কর্মসূচি চালু করা।

সম্প্রতি ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় দাসের বক্তব্য এবং কার্যকলাপ বাংলাদেশের ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে আঘাত করেছে। তার বক্তব্যকে ঘিরে উভয় দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে হামলা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি দুই দেশের সম্পর্কের উপর নেতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে। এই ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক কূটনীতির আদর্শ লঙ্ঘন করে এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাবকে আরও প্রকট করে তোলে। 

বিজেপি নেতাদের কিছু মন্তব্য এবং কার্যকলাপ দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও ক্ষোভ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের বক্তব্য সম্পর্কের উত্তেজনা কমানোর বদলে তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে সংকট সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণগুলি সমাধান করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। চিন্ময় দাশের কার্যকলাপ, আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা, এবং বিজেপি নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে যেমন, দুই দেশের সরকারগুলোর উচিত একে অপরের সঙ্গে সংলাপ বৃদ্ধি করা এবং কূটনৈতিক স্তরে সমস্যা সমাধান করার প্রচেষ্টা জোরালো করা।

 বাংলাদেশের সরকারের উচিত ভারতের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে চিন্ময় দাশের বক্তব্য এবং এর প্রভাব নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া। একইভাবে, ভারতীয় সরকারকে তাদের নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতি নজর দিতে হবে এবং বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে তা নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের সরকার এবং ভারতের সরকার উভয়কেই তাদের জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। দুই দেশের নেতাদের উচিত সাধারণ জনগণের মধ্যে ভুল ধারণা সৃষ্টি না করার জন্য দায়িত্বশীল বক্তব্য দেওয়া এবং ইসলাম, হিন্দু, বা অন্য কোন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করা।

আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা একটি কূটনৈতিক ইস্যু। এরকম হামলার পুনরাবৃত্তি রোধে দুই দেশকেই তাদের কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি, ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিয়ে নিয়মিত সমন্বয় এবং পর্যালোচনা করা উচিত।

ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের মিডিয়াকে দায়িত্বশীলতা এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভুল বা উসকানিমূলক খবর বা বক্তব্য যাতে জাতির মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি না করে, সে বিষয়ে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য মিডিয়া নীতি এবং সমন্বিত কাজের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ভুল ধারণা দূর করা উচিত।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিয়ে ভারতীয় অভিযোগের কারণে, উভয় দেশকে তাদের সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও ভারতীয় মুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে উসকানির সুযোগ কমে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতির কারণগুলি সমাধান করতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব। কূটনৈতিক তৎপরতা এবং যৌথ উদ্যোগে সমস্যাগুলোর সমাধান করা হলে, দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিশ্বে প্রতিবেশী দেশের জন্য মডেল হতে পারে, যদি পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা এবং জনগণের মধ্যে বোঝাপড়া বৃদ্ধির চেষ্টা। সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগিয়ে গেলে ভারত ও বাংলাদেশ কেবল নিজেদের মধ্যে সম্পর্কই দৃঢ় করতে পারবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্যও একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। 


সর্বশেষ সংবাদ