‘আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতাম’

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ছবি

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ "যদি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতাম" শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস লিখেছিলাম। কখনো ভিসি হবো এমন বাসনা নিয়ে লিখিনি বরং যারা ভিসি হবে তাদেরকে কিছু আইডিয়া দেওয়ার জন্য লিখেছিলাম। ভিসি হওয়ার বাসনা থাকলে সাদা অথবা নীল দল করতাম, চুটিয়ে রাজনীতি করতাম। সেটা কখনো করিনি, ভবিষ্যতেও করব না কারণ সেটা করাকে আমি অন্যায় মনে করি। আজকের পরিস্থিতিতে আমার সেই লেখাটিই একটু যোগ বিয়োগ করে একটু নতুনভাবে আবার পোস্ট করছি। 

যদি আমি ভিসি হতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় বানাতাম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেবল ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা থাকবে এবং থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে শিক্ষক কর্মচারীর আবাসিক এলাকা। যেই দেশের ছাত্রছাত্রীরা অপ্রতুল আবাসিক সুবিধার কারণে অমানবিকভাবে ছাত্রাবাসে থাকে সেখানে শিক্ষক কর্মকর্তাদের জন্য বিলাসী আবাসিক ভবন কি মানায়? ছাত্রছাত্রীরা হলের গণরুমে, হলের ছাদে, বারান্দায় অনিরাপদ অবস্থায় রাত্রিযাপন করে জেনেও আমরা শিক্ষক হয়ে ওই একই ক্যাম্পাসে বিলাসী ভবনে শীতনিদ্রায় যাই?   

যদি আমি ভিসি হতাম প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতাম। কারণ প্রথম বর্ষটাই ছাত্রছাত্রীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় ছিটকে পরে গেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে যায়। সেই জায়গায় আমাদের প্রথমবর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যেই পরিমান নির্যাতনের শিকার হয় তা অকল্পনীয়। অথচ এতসব জেনেও আমরা শিক্ষক, প্রশাসন এবং সরকার মুখে কুলুপ এঁটে কি দারুন সুখে আছে। শুধু তাই না প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শিক্ষকরা নির্যাতনকারী ছাত্রদের সর্বরকম সাপোর্ট দিয়ে যায়। ভাবা যায় যে সরকারি দলের ছাত্রনেতা একা একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকে? এমনকি কেউ কেউ পাশের আরেকটি রুমকে ড্রয়িং রুম হিসাবেও ব্যবহার করে থাকে। এইসব কি প্রভোস্টের আস্কারা ছাড়া সম্ভব?

যদি আমি ভিসি হতাম ৪ বছরের অনার্সকেই টার্মিনাল ডিগ্রী হিসাবে কার্যকরী করতাম। সকল প্রকার চাকুরীর নিয়োগ কর্তাদের কনভিন্স করতাম বিসিএস থেকে শুরু করে সকল প্রকার চাকুরীর জন্য ৪ বছরের অনার্সই যথেষ্ট। এইটাকে সফল করতে পারলে ছাত্রদের আবাসিক সংকট অনেকটা কেটে যাবে। মাস্টার্স করবে সিলেক্টিভ শিক্ষার্থীরা যারা একাডেমিয়াতে বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা বা গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসাবে নিবে। জীবনটা ছোট। কেন সবাই মাস্টার্স করে জীবনের শ্রেষ্ট সময়ের দেড় থেকে দুই বছর সময় অপচয় করবে? 

যদি আমি ভিসি হতাম তাহলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রতিটি ক্যাম্পাসে উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ করতাম যেখানে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। নিজেরা লাইন ধরে ট্রেতে করে খাবার এনে আবার খাবার শেষে ট্রে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চলে যাবে। সেই ক্যাফেটেরিয়াতে ছাত্র এবং শিক্ষকদের জন্য কোন আলাদা নির্দিষ্ট স্থান থাকবে না। ছাত্রশিক্ষক একত্রে একই স্থানে বসে খাবে যাতে ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। 

যদি আমি ভিসি হতাম উন্নতমানের জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা করতাম কারণ উন্নত মনের জন্য অবশ্যই উন্নত শরীরের প্রয়োজন। এছাড়া ছাত্রছাত্রীরা সারা বছরজুড়ে যেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে থাকতে পারে তার সুযোগ বৃদ্ধি করতাম। 

যদি আমি ভিসি হতাম লাইব্রেরিকে আরো উন্নতমানের করতাম। বিশেষ করে লাইব্রেরিকে centrally শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করতাম যাতে ছাত্রছাত্রীরা আরামে পড়াশুনা করতে পারে এবং এতে বইগুলো ভালোভাবে সংরক্ষিত হতো। 

যদি আমি ভিসি হতাম ভিসিকে প্রায় invisible করে দিতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা কোথাও ভিসিকে প্রায় অদৃশ্য করে দিতাম। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা জুড়ে কেবল ভিসি ভিসি আর ভিসিময় হইবে? যেদিন দেখবেন ভিসির নাম ছাত্রছাত্রীরা জানে না সেদিন বুঝবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। 

যদি আমি ভিসি হতাম তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষকের বর্তমান যেই পদ্ধতি আছে তা বন্ধ করে দিতাম। এতে পরীক্ষার প্রকাশে যে কাল ক্ষেপন হয় সেটা বন্ধ হতো। মনে রাখতে হবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি মাস সময়ও বাঁচাতে পারি সেটাও অনেক। এই বয়সের প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেই শিক্ষক যেই কোর্স পড়াবে তিনিই প্রশ্ন করবেন এবং কেবল তিনিই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন। বর্তমান করোনা উত্তর পরিস্থিতে এইটা করা এখন আরো জরুরি হয়ে পড়েছে।  

যদি আমি ভিসি হতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৭ কলেজ মুক্ত করতাম। অথবা ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মুক্ত করতাম। আমি বরং সরকারকে উপদেশ দিতাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বানানো যার অধীনে এই সাতটি কলেজসহ ঢাকার বাহিরের আরো কিছু বড় বড় কলেজযে এফিলিয়েটেড কলেজ বানানো। এই কলগুলোতে কেবল ৪ বছরের অনার্স পড়ানো হবে আর মাস্টার্স করবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এই কলেজগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রী পাস কোর্স থাকবে না। বাদবাকি বাংলাদেশের কোন কলেজে অনার্স পড়ানো হবে না। সেই কলেজগুলোতে কেবল এইচএসসি ও ডিগ্রী পাস কোর্স থাকবে। এইচএসসি হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কলেজে অনার্স থাকায় এইচএসসি অবহেলিত হচ্ছিল।    

যদি আমি ভিসি হতাম ভিসির ক্ষমতা কমিয়ে দিতাম। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের নীতিমালাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতাম। শিক্ষক নিয়োগে কম পক্ষে ৩টি স্তর রাখতাম। প্রতিটি স্তরে শর্টলিস্ট করা হবে এবং সব শেষে ভিসি বা প্রোভিসিসহ একটি সেরেমনিয়াল বোর্ডে নিয়োগ চূড়ান্ত হবার ব্যবস্থা করতাম। কয়েকটি স্তর থাকলে দলীয়করণ, নেপোটিজম ইত্যাদি অনেকটা বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষক নিয়োগ ও প্রোমোশনের বিষয়টা সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অনুষদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজে ভিসিদের সম্পৃক্ত থাকার কারণে ভিসিরা সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে নেতৃত্ব দিয়ে উন্নত করা যায় সেইসব নিয়ে ভাববার সময় পায় না।
 
যদি আমি ভিসি হতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে যা দেওয়া হয় ন্যূনতম ৩-৪ গুন করার জন্য জোরালো দাবি জানতাম এবং একই সাথে সকল শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি জানতাম।  

By the way, আমার প্রশাসনে যাওয়ার ইচ্ছে বা প্রোবাবিলিটি তখন ০.০০০০০০০০০০০০১ এর চেয়েও নিচে ছিল। তবে আজকের বাস্তবতায় এইটা একটু বেড়েছে। উপরের কথাগুলো বললাম কেবল একজন পরামর্শক হিসাবে। কেউ যদি কোনভাবে আমার লেখাটি পড়ে একটু হলেও উৎসাহিত হয়ে এর কিছু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন তাহলেই এই লেখার স্বার্থকতা। আমি জীবনে কিছু পাওয়ার জন্য বা পদ পদবীর জন্য কিংবা চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রোমোশনের জন্য দৌড়াইনি এবং দৌড়াব না। নিজের শক্ত মেরুদন্ড নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দই আলাদা।

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত


সর্বশেষ সংবাদ