কোটার প্রভাবে যোগ্যরা বেকার থাকছে, চেয়ার কেড়ে নিচ্ছে অযোগ্যরা

কোটা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণার রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী
কোটা বাতিলের রায় অবৈধ ঘোষণার রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী  © ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান রবিন। তার ছিল পারিবারিক সূত্রে পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা (গ্রান্ডসন)। চাইলেই এই কোটা দিয়ে পড়তে পারতেন আইন বিভাগের মত সাবজেক্টে। কিন্তু, সবার মত সমান সুবিধা পেয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, চরম আত্মমর্যাদাবোধ ও কোটার অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগে সচেষ্ট রবিন ও তার পরিবার এই কোটার প্রয়োগ না করেই যোগ্যতার বলে তিনি পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে। রবিনের মত আরও বাংলার সূর্য-সন্তানরা  অপ্রয়োজনীয় কোটার প্রয়োগে সচেষ্ট এবং তারা সেটি এড়িয়ে চলেন।

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এর পেছনে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে  যারা সংগ্রাম করেছেন, সম্ভ্রম হারিয়েছেন এবং জীবন দিয়েছেন তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাদের প্রতি সম্মান ও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং অনুদান প্রদান করে আসছে। বর্তমানে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

এছাড়াও, সেসব মুক্তিযোদ্ধার পরিবার বর্তমানে সচ্ছল ও সুন্দর জীবন যাপন করছেন। তাছাড়া, সরকার তাদেরকে মাসিক ও বাৎসরিক হারে বিভিন্ন ধরনের অনুদান প্রদান করে যা এখনো সক্রিয় রয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সঠিক চিহ্নিতকরণে নানান জটিলতা বিদ্যমান। এমনকি, এমন ব্যক্তিবর্গ এই মুক্তিযোদ্ধা বেশে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন যার মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই কোনো যোগসূত্র নেই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ শাখা থেকে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম গ্রেড এবং ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাতালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছিল।

সম্প্রতি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে দেওয়া পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। মূলত, গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর ফলে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।

উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এছাড়াও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে রায়ের পর পরই এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীর একটিই স্বরের প্রবাহ বইছে এবং তা হলো, "সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে, মেধাভিত্তিক নিয়োগ চাই, প্রতিবন্ধী ছাড়া কোটা নাই।"

প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষায় লাখ লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর পরিবর্তে নিয়োগ দেয়া হয় মাত্র কয়েক হাজার ক্যান্ডিডেটকে। এরই মধ্যে যদি ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন কোটাধারীদের নিয়োগ দেয়া হয় তাহলে সেই বিসিএস যা প্রতিটি পরিবারের একটি সোনার হরিণ তা রুপোর হরিণে পরিণত হবে।

এছাড়াও, রেলওয়ে ও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে যথাক্রমে ৮২% ও ৯৬% বিভিন্ন ধরনের কোটা বিদ্যমান যার ফলে এই দুই ক্ষেত্রেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়োগ প্রায় নগণ্য, যার বিপরীতে দেশে প্রস্তুত থাকছে লাখ লাখ বেকার। মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অপ্রয়োজনীয় কোটায় দেশের চাকরি ব্যবস্থা পরিপূর্ণ, যেখানে একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা সাধারণ শিক্ষার্থীর চোখে শুধু ধোঁয়াশা।

আজ বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশের অধিক সময় পার করেছে। একজন সাধারণ পরীক্ষার্থী যে পরিবেশে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বেড়ে ওঠে তার সমপর্যায়ের বা তার থেকে ভালো পরিবেশ পেয়ে বড় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিরা। তাদের আর্থিক সহায়তা বা অনুদান প্রদানের বিষয়ে দেশের সাধারণ জনগণের কোন মাথাব্যথা নেই। তবে, দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের জন্য যোগ্য ব্যক্তির সঠিক স্থানে থাকা প্রয়োজন।

অন্যদিকে, এই কোটাতন্ত্রের ফলে যোগ্য ব্যক্তিরা বেকার থাকছে এবং অযোগ্যরা তাদের চেয়ার কেড়ে নিচ্ছে। যার ফলে দেশের উন্নয়ন থাকছে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে, এই "বিশেষীকরণ" পদ্ধতি নিয়ে আসে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির মত বিষয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের জনগণের পয়সা থেকে আরও ভর্তুকি দেয়া হোক কিন্তু, সরকারি চাকরিসহ আরও অন্যান্য ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বাস্তবায়ন করা উচিত। দরকার হলে কোটাযুক্ত পরিবারে আরও তহবিল প্রদান করা হোক যাতে করে তারা সাধারণদের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হতে পারে।

তবে, মনে হয় না তার প্রয়োজন রয়েছে কেননা স্বাধীনতার পঞ্চাশের অধিক বছর ধরে তারা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে এবং তারা সাধারণ পরীক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করা যাবে না, কিন্তু প্রতি বছর মুক্তিযোদ্ধা থেকে তার পরবর্তী প্রজন্মে যুক্ত হচ্ছে আরও তিন থেকে চার গুণ কোটাধারীর সংখ্যা, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিষয়। 

গণতন্ত্রের নামে দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে কোটাতন্ত্র, যা এই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি চেতনার মূলমন্ত্রের অন্তরায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ আরও সব অবাঞ্ছিত কোটা বাতিল ঘোষণা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তির জন্য দল, মত নির্বিশেষে যেভাবে মানুষ সমানভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আশায় ঠিক সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে সকল মানুষকে সমান সুবিধা-সুবিধা প্রদান করে বাংলাদেশকে এই পৃথিবীর মানচিত্রে একটি উন্নত দেশ ও জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এখনই সময়।

লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ সংবাদ