সশস্ত্র বাহিনী দিবস: মুক্তিযুদ্ধে সম্মিলিত সামরিক প্রতিরোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত 

আরজুনা আক্তার
আরজুনা আক্তার  © টিডিসি ফটো

পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছরের দানবীয় নির্যাতন, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটাতে ১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করতে সময় লাগে দীর্ঘ নয় মাস। এই সময়ে যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও রণকৌশল প্রয়োগ করা হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও রণকৌশলের মধ্যে রয়েছে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা, রণাঙ্গনকে ১১ টি সেক্টর ও ৬৪ টি সাব-সেক্টরের ভাগ করার মত বিষয়গুলো। এমনই একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল ২১ নভেম্বর ১৯৭১।

দিনটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বাস্তবরূপ প্রদানে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধ শুরু করে। একই দিনে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার ও তৎকালীন ভারত সরকারের সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান) ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়। যা পরবর্তীতে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই উল্লেখযোগ্য দিনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অবিস্মরণীয় অবদানকে দেশের আপামর জনগণের আত্মত্যাগের সঙ্গে মহিমান্বিত করার লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকে দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় দিবস হিসেবে অনন্য স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

মূলত পাকিস্তান পেশাদার হানাদার বাহিনীর উপর স্থল, নৌ ও বিমান পথে সর্বাত্মক হামলা জোরদার করার লক্ষ্যেই যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। নভেম্বরে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর উপর্যুপরি স্থল ও গেরিলা আক্রমণের মুখে পাকিস্তান বাহিনী দিশেহারা হয়ে পরলেও তাদের অত্যাধুনিক সামরিক মারণাস্ত্র ও নৌ বিমান হামলা চিরতরে রুখে দিতে সশস্ত্র যৌথ বাহিনী ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। যৌথ বাহিনীর ত্রিমুখী কৌশলী আক্রমণের ফলে ২১ নভেম্বর পরবর্তী প্রতিটি দিনই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যৌথ বাহিনী বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। দিনটি মুক্তিবাহিনীর মনোবল উজ্জীবিত করে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের কুপোকাত করতে দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছিল। ফলে, দিনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র ২৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ লাল সবুজের বিজয় নিশান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এসব অর্জন ও সাফল্য পরিমাপে নিঃসন্দেহে যৌথ বাহিনী গঠন মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রশংসনীয় ও যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত ছিল।

২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী গঠন ইয়াহিয়া খানকে চরমভাবে ভাবিয়ে তোলে। পাকিস্তান সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে ভুল তথ্য উপস্থাপনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে অপপ্রচার চালানোর  চেষ্টা করে। অন্যদিকে, ২১ নভেম্বর যৌথবাহিনী তাদের প্রতিষ্ঠার দিনই প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার বয়রা সীমান্তের গরিবপুর এলাকায়। এই লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর সাথে অংশ নিয়েছিল ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ৪৫ ক্যাভালরির স্কোয়াড্রন ও ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা। এই আক্রমণে যৌথ বাহিনী অভাবনীয় সাফল্য লাভ করে যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গরিবপুর  যুদ্ধ বা চৌগাছা যুদ্ধ নামেও পরিচিতি পায়। অনেকেই এই যুদ্ধের তাৎপর্যময় ফলাফলের কারণে "স্বাধীনতার প্রবেশদ্বার" বলেও উল্লেখ করেছেন।  যৌথবাহিনীর এ যুদ্ধটি  যুদ্ধের সামরিক কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন সামরিক কলেজে পাঠদান করানো হয়। উল্লেখ যে, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে  বীরত্বগাঁথা এ যুদ্ধ নিয়ে বলিউডে "পিপ্পা" (২০২৩) নামের একটি চলচিত্রও নির্মিত হয়েছে।

অন্যদিকে, ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী গঠন হলে পরোক্ষভাবে ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি  ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিশেষ উপস্থিতি যুদ্ধের মোড় স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে। এতদিন মুক্তিবাহিনী, গেরিলা বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীর বিশেষ তিনটি ফোর্স বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধে জয়লাভ করলেও পাকিস্তান বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও বিমান হামলার কাছে টিকতে না পেরে মুক্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে নি। ২১ নভেম্বর যৌথ বাহিনী গঠনের কারণে বিজিত অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সহজ হয়। যৌথ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের ফলেই একমাস না যেতেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই যৌথ বাহিনীর কাছেই পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে চূড়ান্ত বিজয়। প্রকৃতপক্ষে এ বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বরের সম্মিলিত আক্রমণ।

মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকার হাত ধরে বর্তমানেও সশস্ত্র বাহিনী দেশ ও জাতি বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় সংকটে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত আপামর জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও নির্মাণ কাজ সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ভূমিকা রাখছে। দেশের পাশাপাশি বিদেশে তারা সুনামের সাথে কাজ করছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ ২য় স্থান অধিকার করেছে। এসব অর্জন সম্ভব হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত নিয়মকানুনের প্রচেষ্টার দরুন। প্রকৃতপক্ষে, সামরিক বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল ২১ নভেম্বর ১৯৭১।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।                                             


সর্বশেষ সংবাদ