মহামারির সময় যে হাসপাতাল রোগীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ওঠে

মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল  © টিডিসি ফটো

রাজধানীর মান্ডা থেকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন শামসুল হক (৬০)। তিনি বলছিলেন, অনেকক্ষণ ধরে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকলাম, কিন্তু কাজ হলো না। এই বৃদ্ধ বয়সে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাও যে নেই। তারপরও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছি। আমার শ্বাসকষ্ট ও রক্তচাপজনিত সমস্যা রয়েছে। তিন বছর ধরে এ হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা নিচ্ছি। তবে আজ সিরিয়াল না পাওয়ায় চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে।

শামসুল হকের মতো অনেকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা নিতে। তবে নানান সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সেবাবঞ্চিতও হতে হয় মাঝেমধ্যে। এ ধরনের কিছু সংকট থাকলেও মহামারির সময়ে স্থানীয় রোগীদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে ওঠে হাসপাতালটি। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু, ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া এবং ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় এ হাসপাতাল রোগীদের প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গত সোমবার (১৭ মার্চ) হাসপাতালটি ঘুরে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।

হাসপাতালের আউটডোর সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চালু থাকে। এখানে বহির্বিভাগের রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারেন। ইনডোর বিভাগ পুরো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। ফলে ভর্তি হওয়া রোগীরা সার্বক্ষণিক চিকিৎসা পান। জরুরি পরিস্থিতিতে ইমার্জেন্সিও ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। সেখানে রোগীরা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সুবিধা পান। এছাড়া সন্ধ্যার শিফটও থাকে, যা রোগীদের সেবা আরও সহজলভ্য করে তোলে। 

ফরিদপুর থেকে এসেছিলেন ৪৫ বছর বয়সী রহিমা বেগম। কিডনি সমস্যা রয়েছে তার। তিনি বলেন, তিন বছর আগে আমি এখানে দুমাস ভর্তি ছিলাম। চিকিৎসার জন্য আমাকে প্রতি মাসে আসতে হয়। কিন্তু চার-পাঁচ মাস আসা হয়নি। তাই ডাক্তাররা আমাকে বকাঝকা করেছেন। কারণ আমি ক্রিটিক্যাল রোগী। এর আগে আমি অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। আজ ডাক্তাররা বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছেন, যা ভালো কোনো হাসপাতালে করাতে হবে।’

চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রহিমা বেগম বলেন, ‘এখানকার ডাক্তাররা খুব ভালোভাবে রোগী দেখেন। এর আগেও আমি এখানে চিকিৎসা নিয়ে উপকার পেয়েছি। তাদের দেওয়া চিকিৎসায় আমার কিডনির সমস্যা কিছুটা ভালো হয়েছিল। তাই আমি এখানে আবার এসেছি।’

হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম নিয়ে সহকারী পরিচালক ডা. মো. হাসনাত আল মতিনের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্বই হলো মানুষের সেবা দেওয়া। যেহেতু এটি একটি সরকারি হাসপাতাল, তাই আমরা ২৪ ঘণ্টাই চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করে থাকি, যাতে রোগীরা যেকোনো সময় প্রয়োজনীয় সেবা পান।’

তিনি জানান, হাসপাতালের আউটডোর সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত চালু থাকে। এখানে বহির্বিভাগের রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারেন। ইনডোর বিভাগ পুরো ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। ফলে ভর্তি হওয়া রোগীরা সার্বক্ষণিক চিকিৎসা পান। জরুরি পরিস্থিতিতে ইমার্জেন্সিও ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। সেখানে রোগীরা তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সুবিধা পান। এছাড়া সন্ধ্যার শিফটও থাকে, যা রোগীদের সেবা আরও সহজলভ্য করে তোলে। 

এ কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিটি রোগীকে যথাযথ ও নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসাসেবা প্রদান করা। আমরা সর্বদা চেষ্টা করি, যেন কেউ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। আমাদের হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসাসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। যদিও এটি একটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু এখানে দৈনিক ৮০০ থেকে ৯০০ রোগী ভর্তি থাকেন। 

আরো পড়ুন: সাবেক সাত উপাচার্যসহ ২০১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা

রোগীর অতিরিক্ত চাপ সামলাতে অতিরিক্ত ২৫০টি শয্যার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এতে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব হয়। তবুও রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক সময় শয্যার সংকট দেখা দেয়। অনেক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত রোগী যখন দেখেন হাসপাতালে বেড নেই, তখন তারা অন্য হাসপাতালে চলে যান। কিন্তু আমাদের পক্ষে কোনো রোগীকে ছাড়িয়ে দিয়ে নতুন রোগী ভর্তি করানো সম্ভব নয়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যাতে প্রতিটি রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে পারেন।’

বিভিন্ন মহামারির সময় হাসপাতালের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা ২০১৫ সালে। এরপর থেকে আমাদের হাসপাতাল বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে এবং সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১৬ সালে ডেঙ্গু মহামারির সময় আমরা অত্যন্ত সঠিকভাবে ও কার্যকরীভাবে ডেঙ্গু মোকাবেলা করেছি। এ কারণে অনেকে আমাদের হাসপাতালকে ডেঙ্গু হাসপাতাল বলে চেনেন। আমরা ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করি।

২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়ার মহামারির সময়ও হাসপাতালটি আরও একবার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চিকিৎসা প্রদান করেছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। এ সময় ডাক্তার ও নার্সদের চেষ্টার কোনোরকম কমতি ছিল না। 

ডা. মো. হাসনাত আল মতিন বলেন, কভিড-১৯ মহামারির সময় আমাদের হাসপাতালটি একটি ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে কাজ করছিল। এ কারণে অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে আসতেন। ফলে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পায়। এখানে মোট ৪৬টি আইসিইউ বেড আছে। যদি হঠাৎ কোনও ইমারজেন্সি রোগী আসে, তাহলে আমরা রোগীকে OSEC (One Stop Emergency and Casualty) পাঠিয়ে দিই। OSEC-এ আমাদের ছয়টি আইসিও বেড রয়েছে। তবে একসাথে অনেক রোগী আসলে এটি আমাদের জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের হাসপাতালে লজিস্টিক সাপোর্ট যথেষ্ট রয়েছ। কিন্তু উন্নত চিকিৎসা প্রদান করার জন্য আরও লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন। আমাদের ক্যাথ ল্যাবটি ২০২২ সালে আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে আমরা একটি নতুন ক্যাথ ল্যাব স্থাপনের জন্য কাজ করছি। মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা চলছে এবং তারা আমাদেরকে নতুন ক্যাথ ল্যাব সরবরাহ করবে। এই ক্যাথ ল্যাবের মাধ্যমে এনজিওগ্রাম করা এবং রিং পরানো সম্ভব হবে। আশা করি, এটি আমাদের চিকিৎসার মান আরও উন্নত করবে।

আরো পড়ুন: দেড় যুগ পর শেষ হচ্ছে ঢাবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ‘বাহালুল হক চৌধুরী অধ্যায়’

তিনি আরও বলেন, আমাদের হাসপাতাল একটি জেনারেল হাসপাতাল হওয়ায় এখানে সব ধরনের রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে গাইনি, মেডিসিন, গ্যাস্ট্রোলজিসহ অন্য সব রোগী সেবা পান। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের রোগী আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হন। আমরা প্রতিটি বিভাগের জন্য সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করি। এই বৈচিত্র্যময় রোগীর আগমন আমাদের হাসপাতালকে একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখানে সব ধরনের রোগীর জন্য উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করা হয়। 

তিনি আধুনিকায়নের গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেন, আমরা বর্তমানে একটি অটোমেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে আছি। এর প্রধান লক্ষ্য হলো আমাদের হাসপাতালের সব কার্যক্রম কম্পিউটারাইজ করা। এটি শুরু হবে ডেস্ক থেকে এবং পর্যায়ক্রমে রিপোর্টিং পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়াকে ডিজিটালভাবে সন্নিবেশিত করা হবে। আমাদের আরেকটি উদ্যোগ হচ্ছে একটি অনলাইন ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করা। সেখানে রোগীরা বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে অ্যাপসের মাধ্যমে সহজেই টিকিট কিনে ফেলতে পারবেন।

সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত, আমাদের নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা অপর্যাপ্ত। এটি আমাদের হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু সমস্যা সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সংকটের কারণে প্রকল্পটির কিছু অংশ বাস্তবায়নে বাধা আসছে। এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি, যাতে আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারি এবং রোগীদের সেবার মান আরও উন্নত করতে পারি।


সর্বশেষ সংবাদ