একজন আমার গলা কেটেছিল, সেই শোকে আমিও কাটা শুরু করলাম

প্রতীকী
প্রতীকী  © সংগৃহীত

প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর পুরুষদের আবেগ নিয়ে খেলা করা আমার মোটামুটি নেশায় পরিণত হল। তখন আমার মধ্যে কোনো ছেলের প্রতি তীব্র ভালোবাসাবোধ ছিল না; শুধু মনে হত এত ভালোবাসাসির কী আছে? শুতে পারলেই হলো।

এক সাথে চারজন প্রেমিক থাকাকে আমি মোটেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করতাম না। বলা যেতে পারে নিজেকে মানবী হিসেবেই গণ্য করতাম না। নিজেকে মনে হত উদ্ভিদজগতের ‘ফ্লাইপেপার ট্র্যাপ’। এই গাছগুলো নিজেকে উন্মুক্ত করে রাখে আর পোকার দল তীব্র আকর্ষণে কাছে আসতেই খপ করে ধরে একেবারে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে বেশিরভাগ পুরুষকে ঘায়েল করা কোনো কঠিন কাজ না, হোক সে বিবাহিত বা অবিবাহিত। খুবই কম সংখ্যক পুরুষ আছে যাদের ঘায়েল করতে নারীদের সাংঘাতিক বেগ পেতে হয়।

আমি মোটেও এমন ছিলাম না। আট-দশটা মেয়ের মত আমার জীবনেও একজন এসেছিল। যাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসতাম, সেও বাসতো। তার সামান্য একটু জ্বরে  আমি তীরবিদ্ধ পায়রার মত সারারাত ছটফট করতাম। তার শরীরের একশো এক ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় আমার কলিজা পুড়ে ছাই ছাই হয়ে যেত।

অভিমান ভাঙাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হলের সামনে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম। খোঁজ নিতে দেরি হলে নালিশ করতাম এত। একটুখানি হাত ছুঁয়ে দেয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করতাম কত! 

একদিন সাবিত আমাকে এক মুঠো চকলেট দিয়ে বলল, বেকারদের সাথে প্রেম করলে চকলেট খেতে হয়। পরক্ষণেই একটা বই দিল মীর মোশাররফ হোসেনের লেখা আত্মজীবনী ‘বিবি কুলসুম’। এটি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে লেখা। সাবিত সেদিন আমার চিবুক ছুঁয়ে বলেছিল, তুমি হবে আমার বিবি কুলসুম। কী জানি হুট করে চোখে জল এলো আমার। কেউ আমাকে এত ভালোবাসবে ভাবিনি কোনোদিন।

আমি একটা ভাঙা ঘরের মেয়ে। ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। আমার নানা অন্য এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ধুমধাম করে বিয়ে দেন আমার মাকে। যথারীতি বাবাও বিয়ে করলেন। আমি বাবার কাছেই থাকতাম। তবে আশ্চর্যজনকভাবে আমার প্রতি বাবার সেই ভালোবাসা আর থাকলো না। আমি যেন অচ্ছুত কোনো বস্তু।

হোস্টেলে হোস্টেলেই জীবন পার হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মন চাইলে দুই একদিনের জন্য অতিথির মত যাই। সবটা জেনেই আমার জীবনে প্রদীপের সলতের মত ভালোবাসার দ্বীপ জ্বেলে দিল এই মানুষটি।

হোক সে বেকার, আমি জানি কোনো একদিন নিশ্চয়ই জল-জোছনায় খেলা করা থইথই জলের কিনারে আমাদের ঘর হবে। উঠোনে ঝাঁক ঝাঁক পড়ে থাকবে শিউলী। ঘ্রাণে ম-ম করবে চারদিক। আমি হয়ত মুঠো ভরা শিউলী গালে ছুঁয়ে ভাববো জীবন সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর!

চারটা টিউশন করে আমার যা থাকে বাকিটা আমি জোর করে তার পকেটে ঢুকিয়ে দিতেই সে ইতস্তত কর উঠতো।  অনেক কিছু বলতে চাইতো। আমি তখন  হাত ছুঁয়ে বলতাম, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আমি চাই তুমি শুধু নিশ্চিন্তে পড়। আমি চাই না দেখা বা ঘুরতে যাওয়ার নামে এতটুকু সময় নষ্ট হোক।

শ্রেষ্ঠ একটা দিন আমার জীবনে এসেছিল যখন শুনলাম সাবিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। সাবিত আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মানুষের মত কেঁদে ফেললো। ওর কান্নাজড়ানো কণ্ঠে আমি শুধু এইটুকু শুনতে পেলাম, সব কৃতিত্ব তোমার।

সেই মানুষটাই কোনো একদিন হুট করে আমাকে না জানিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবে তা দুঃস্বপ্নেও আসেনি কোনোদিন। সেদিন শ্বাসকষ্টের রোগীর মত দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। ছাদ থেকে লাফ দিব নাকি চাকু দিয়ে শিরা কাটব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

বুকের ভেতর থৈ-থৈ করে উঠছিল বেদনার জলোচ্ছ্বাস। কত যে নিশুতি রাতের ডাহুকের মত ডুকরে কেঁদেছি হিসেব নেই। আহা প্রেম তুমি চোখের জলে ধুয়ে যাও। প্রায় দুই মাস পর একদিন আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। যত্ন করে যে চোখে কাজল দিতাম এক সময় সেই চোখ জোড়ায়  কালিতে ভরে গেছে আপনাতেই। ঝলমলে চুল ঝরে গেছে অর্ধেক।

কী ভেবে ওড়নাটা সরিয়ে খাটে রাখলাম। আয়নার আরও কাছে গিয়ে দেখলাম নিজেকে। খুব অদ্ভুতভাবে মনে হতে থাকলো আমার প্রেমিকের স্ত্রীর চেয়ে রূপে, মেধায় আমি কোনো অংশেই কম নই।

হুট করে কেমন জেদ চেপে বসলো। আর কারো জন্য কষ্ট পাওয়া নয়। উহু একদম নয়। ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়র মাঝে মাঝে এমনিতেই আমার পড়ালেখার খোঁজ খবর নিতে নক দিতেন। কী ভেবে তার সাথে আমি কথা বললাম অনেকক্ষণ। সেদিনই জেনেছিলাম তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। 

এরপর দিন দিন আরও কথা হতে  থাকলো। কী তীব্র মোহে তিনি বারবার আমার সাথে যোগাযোগ করতে থাকলেন! আমি তাকে সাদরে গ্রহণ করলাম। মানুষ অ্যালকোলহের নেশায় ডুবে বেদনা ভুলে যায় আমার মনে হতে থাকলো শরীরী নেশায় আমি সেই মনঃকষ্ট ভুলে যেতে পারি।

একদিন আমার সাথে দেখা করতে এসে রিকশায় নিয়ে ঘুরলেন অনেকক্ষণ। ধানমন্ডি লেকে গিয়ে আমার হাত ছুঁয়ে থাকলো। হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আজ আর ফিরে যেতে চাই না।

তিনি তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানালেন জরুরী কাজে তাকে  আজই চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে। তিনি আজ রাতে বাসায় ফিরবেন না। তার কিছুদিনের মধ্যে প্রেম হল অন্য এক জুনিয়রের সাথে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করতো আমার সাথে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো? হয়ত দুষ্টুমি করেই উত্তর দিল, জ্বী আপু।

আমি খানিকটা গম্ভীর গলায় বললাম, তাহলে আপু ডাকছো কেন? তারপর এখানে সেখানে ঘুরতে যাওয়া,  খাওয়া দাওয়া, অন্ধকার রাস্তায় চুমু খাওয়া সবটাই তো হয়েছে। আমার প্রতি তার অনেক ভালোবাসা ছিল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই ভালোবাসা আমার হৃদয় ছুঁতে পারেনি। 

একবার দুর্ঘটনায় সাতদিন আইসিইউতে ছিল। একদিন অভিমানী গলায় রায়হান জানতে চাইলো, একদিনও জানতে ইচ্ছে করলো না বেঁচে আছি নাকি মরেই গেছি? দেখতে আসা দূরে থাক ফোনও দিলে না? আমি নির্বিকার গলায় উত্তর দিলাম, আমার অত ভাবার সময় কোথায়? 

মাঝে মাঝে গভীর রাতে ফোন ওয়েটিং পেত। একদিন জিজ্ঞেস করলো, কার সাথে কথা বলো? আমি চেঁচিয়ে উত্তর দিলাম, তোমার কাছে জবাবদিহি করার প্রয়োজন বোধ করি না। পোষালে থাকো, না পোষালে বিদেয় হও। 

তৃতীয়জনের অবশ্য প্রেমিকা ছিল অন্য একজন। তবুও সে আমার সাথে প্রেম চালিয়ে গেছে দেদারসে যদিও প্রথমদিকে তার প্রেম অস্বীকার করতো অকপটে অবশ্য তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। বিশিষ্ট শিল্পপতির সন্তান সে। মাঝে মাঝে দামী গিফট, রেস্টুরেন্ট কোনোকিছুরও অভাববোধ করিনি।

এর মধ্যেই একদিন কী ভেবে নক দিয়ে বসলাম কলেজের এক ক্লাসমেটকে। কলেজ লাইফ থেকে সে আমাকে পছন্দ করে তা আমি জানতাম। একদিন সাম্যকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো? সাম্য বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দিল, ভালোবাসি কিনা জানি না তবে আমি চাই তুমি যেখানেই থাকো বা যেভাবেই থাকো সব সময় ভালো থাকো, তুমি আমার না হলেই বা কী যায় আসে? আমার এই শুভকামনাকে যদি ভালোবাসা ধরে নাও মনে কর তবে তাই।

আরও পড়ুন: প্রথম প্রেম কেন ভোলা যায় না

আমি মুচকি হাসলাম। মানুষের মনের দুর্বল জায়গা খুঁজে পাওয়া ভীষণ আনন্দের। ততদিনে আমার নেশা হয়ে গেছে। কেউ একজন আমার গলা কেটে ফেলেছিল সেই শোকে আমি গলা কাটা শুরু করলাম। আমি নিয়মিত সাম্যের খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম। খেয়েছে কিনা,  অসুস্থ কিনা,  মন খারাপ কিনা। 

সাম্য ক্রমশ আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা রাধারমণের গানের মত হলো, ‘‘নিভা ছিল মনের আগুন কী দিলা জ্বালাইয়া...’’ সাম্য গ্রামের একটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছে। আমার প্রতি সেই তীব্র আকুতি নিয়ে সে কখনও কিছু বলার সাহস পায়নি। কলেজে পড়াকালীন কয়েকজনের কাছে শুনতাম আমাকে নিয়ে সে দুই চারটা কবিতা লিখেছিল ওই পর্যন্তই।

তারপর আমার চান্স হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমেস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে। এরপর সাম্য  নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল  রেশম পোকার মত। এরপর সাম্য একদিন চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকা এলো। আমি ইচ্ছা করেই বললাম, পরীক্ষা শেষে  তুমি টিএসসি এসো দেখা করব। গ্রামের সেই সরল ছেলেটির মনে রাজ্যের বিস্ময়।

আমার ঝলমলে চুল ছেড়ে দিয়ে চোখে কাজল দিলাম যত্ন করে। কালো রঙের টিপ দিলাম আর হালকা লিপস্টিক। কেউ আমার প্রেমে পড়ে আকুলি বিকুলি করবে তা ভাবতেই আমার ভেতরে কেমন উন্মাদনা কাজ করতো।

গোটা গোটা সরল চোখে সাম্য আমার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না, সম্ভবত লজ্জা কিংবা খানিকটা অস্বস্তিবোধ করছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম ওর নিজের আর বাড়ির সবার খবর। আমি ইচ্ছে করেই খানিকটা গা ঘেঁষে বসেছিলাম। সাম্য নিজে থেকেই সামান্য সরে গেল। আমি মনে মনে হাসলাম একটু।

সাম্য চলে যাওয়ার পর আমি নিজে থেকেই ওর খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলাম আরও। আমাকে উপেক্ষা করার সাধ্য ওর ছিল না। এরপর মাঝে মধ্যেই দেখা করতে আসতো। আমিও ভীষণ দায়িত্বশীল প্রেমিকার মত মাঝে মধ্যে রান্না করে দুই একবার খাইয়েছি। সাম্যের সাথে থাকা অবস্থায় বাকি তিন প্রেমিকের কেউ হুট করে ফোন দিলে আড়ালে গিয়ে বলতাম লাইব্রেরিতে আছি।

এই লাইব্রেরি থিউরি আমার তৃতীয় প্রেমিক মুনতাসিরের কাছ থেকে শেখা। আমার সাথে শুয়ে থাকা অবস্থায় তার প্রেমিকা ফোন দিলে সে অকপটে বলতো, লাইব্রেরিতে আছি। ফোন রাখ। আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতাম তখন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছিলেন, আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে। নতুন প্রেমে সাম্যের সাথে সময় কাটছিল বেশ। আমি টের পেতাম সে আমার হাত ছুঁতেও খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে থাকতো প্রথম প্রথম। একদিন হঠাৎ নিজে থেকেই জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিলাম, আমাকে তোমার কাছে পেতে ইচ্ছে করে না? সে সরল গলায় উত্তর দিল, কাছেই তো আছো। 

আমি কপট রাগ করার অভিনয় করলাম কতক্ষণ। সেদিন রাতেই সাম্য আমাকে বলল, চল মা-বাবাকে বলে বিয়ে করে ফেলি। একটু সমস্যা করবে কিন্তু কান্নাকাটি করলে শুনবে মনে হয়। জিজ্ঞেস করেছিলে কাছে পেতে চাই কিনা অবশ্যই চাই কিন্তু চিরদিনের জন্য।

এই ছেলের কথা শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হল। মনে মনে ভাবি, বিয়ে কে করবে? পড়ার ক্ষতি হবে সেই অজুহাতে ও যাত্রা বেঁচে গেলাম এরপর আমি আর কোনোদিন এই প্রসঙ্গ তুলিনি ভয়ে।

কেটে যাচ্ছিলো এমন করেই। একদিন হঠাৎ পায়ের ব্যথায় আমি কাতর হয়ে গেলাম। জ্বর এলো হুড়মুড়িয়ে। আমার কণ্ঠ শুনেই সাম্য ব্যাকুল হয়ে পড়লো। পরদিন সকালেই টাংগাইল থেকে সোজা ঢাকা। ডাক্তারের কাছে দৌঁড়ালাম অনেকদিন। পায়ের সমস্যা কী হয়েছে তা বুঝতে বুঝতে আমার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। রাত দিন পায়ের ব্যথায় ব্যাকুল হয়ে কাঁদি। ব্যথার ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকি। ওদিকে আমার পায়ের একটা অংশ কালো হওয়া শুরু করলো। শেষমেশ একজন ভাস্কুলার সার্জন জানালেন রক্তনালি ব্লকড হয়ে গ্যাংরিন হয়েছে পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।

আমার পুরো দুনিয়া পাল্টে যেতে থাকলো তখন থেকেই। সাম্য আমার সেই অর্ধ পঁচা পা কোলে নিয়ে বলেছিল, এমন কিছুই হবে না দেখো। তারপর জানি না কোত্থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে টাকা জোগাড় করল। বেকার মানুষ টাকা পাবে কোথায়? হয়ত ধারদেনা করেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমাকে নিয়ে ছুটে চলল ভারতের অ্যাপোলো হাসপাতালে।

ততদিনে বাকিদের সাথে আমার দূরত্ব হয়ে গেছে। যতদিন শরীর ছিল আমিও ছিলাম কিন্তু আমার শরীরের একটা অংশ যদি কেটেও ফেলতে হয় আমি জানি সাম্য আমার পাশেই থাকবে। সেটা আমি আরও ভালো করে বুঝতে পারলাম একটা অচেনা শহরে গিয়ে। আমি ঘুমিয়ে গেলে সেই পা কোলে নিয়ে বসে থাকতো আমি টের পেতাম সেই পা চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে।

একদিন আয়নার সামনে যে রূপ নিয়ে বড়াই করেছিলাম কী অদ্ভুতভাবে আমার রূপের ঘাটতি পড়ে গেছে, পা কেটে ফেললে পুরোটার ঘাটতি পড়বে। হাসপাতাল শুদ্ধো দৌঁড়াদৌঁড়ি আর চিন্তায় সাম্যের চোখ একেবারে গর্তে চলে যাওয়ার উপক্রম। কী আশ্চর্য! এই চোখে ভালোবাসা খুঁজিনি কোনোদিন।

দীর্ঘদিন চিকিৎসা চললো। সার্জারি হলো কয়েকটা। খুবই অদ্ভুতভাবে আমার পা কেটে ফেলতে হলো না।ডাক্তাররা বললেন আমি ভাগ্যবতী। সাম্য সেদিন ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল আনন্দে। যত্ন করে একটা নুপূর পরিয়ে দিয়েছিল পায়ে।  সেদিনই আমার জীবনের একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। 

সুস্থ পায়ে আমি দেশে ফিরে এলাম। কতদিন পর আবার গটগট করে হাঁটতে পারছি। এই প্রথমবারের মত মনে হল আমার বুকের ভেতর খচখচ করছে। তুলোর বিছানায় কেউ যেন  পেরেক পুঁতে রেখেছে। একেবারে ঘ্যাচ করে ঢুকে যাচ্ছে অন্তরে।

শুদ্ধ প্রেম আমাদের জীবনে অবশ্যই আসে কিন্তু জেদ করে হোক, সাময়িক মনঃকষ্ট দূর করতে হোক  কিংবা প্রতিশোধ নিতে হোক সেই প্রেম খুঁজতে গিয়ে আমরা নিজেকে এতটাই অশুদ্ধ করে ফেলি যে সেই শুদ্ধ প্রেমের সামনে দাঁড়ানোর স্পর্ধা আর থাকে না। এই যেমন আমার হচ্ছে না। উপলব্ধি করালাম মনের তৃষ্ণা শরীরী ক্ষিধেয় মেটে না।

কে কবে ঠকিয়েছিল সেই জেদে নিজেকে এতটা অতলে নিয়ে গেলাম এখন আর তীরে উঠার কূল পাচ্ছি না  অথচ আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতাম। চোখের জল মুছে আবার জীবনকে ফুলের মত সুবাসিত করতে পারতাম। আমার বুকের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে। খরস্রোতা নদী যেমন পাড় ভেঙে দেয় অমন। ডাঙায় ফেলে রাখা মাছের মত তড়াপাচ্ছি কতক্ষণ। আমি তৎক্ষণাৎ সাম্যকে ম্যাসেজ দিয়ে আমার জীবনের সবটা জানালাম,সবটা।

আমি জানি হয়ত ও আমাকে ক্ষমা করে দেবে কিন্তু তার সেই মহত্ত্বের সামনে দাঁড়ানোর দুঃসাহস আমার নেই অথবা ঘৃণা করবে কিন্তু সেই ঘৃণা সয়ে যাওয়ার সাধ্যও আমার নেই। আমি ওর জবারের অপেক্ষা না করে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। সিমটা ভেঙে গুড়িয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। আমার পায়ে থাকা নুপূরটা খুলে  চুমু খেলাম। আমার শুদ্ধতম প্রেম তুমি বেঁচে থাকো আমার অন্তরে। 

যে প্রেম আসে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মত তা শীতলতা দিয়ে যায় আর যে প্রেম আসে ঝড়ো হাওয়ার মত তা ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে যায়। সাম্য আমার সেই শীতল বৃষ্টি। সেই যে প্র‍থম প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আহত ডাহুকের মত কেঁদেছিলাম অমন করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম অজান্তে। আমি জানি এরপর আর কোনোদিন আমার সাম্যের সামনে গিয়ে আমি দাঁড়াবো না, কোনোদিন কথা হবে না। কত মানুষ ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে জিতে যায়। কী আশ্চর্য আমি তাকে চিরদিনের জন্য না পেয়েও জিতে গেলাম!

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ