বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির আবির্ভাব ও গুরুত্ব

খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছিলেন, 'নিভৃত গিরি-কন্দরে বারিরাশি সঞ্চিত হইয়া থাকে, একদিন সেই পাষাণ বেষ্টনী ভেদ করিয়া বারিরাশি নিম্ন অভিমুখে ছুটিয়া চলে অমৃতপ্রপাত রূপে। সেইরূপে ভাগবতের অপূর্ব কাব্যরস লৌকিক ভাষায় নামিয়া আসিল প্রথম বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের পদাবলিতে। ভাব যেমন প্রবল, প্রতিভাও তেমনি প্রদীপ্ত। এইরূপ শুভযোগেই বৈষ্ণব পদাবলির জয়যাত্রা শুরু হইয়াছিল।'

প্রবাদেই রয়েছে 'কানু বিনে গীত নাই'। 'বৈষ্ণব অর্থে বিষ্ণু সম্বন্ধীয়' বোঝালেও, বৈষ্ণব পদাবলি-সাহিত্যে পৌরাণিক বিষ্ণুর কথা নয়, কৃষ্ণলীলা তথা রাধা-কৃষ্ণলীলা বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণ পৌরাণিক দেবতা হলেও প্রাচীন কোনো পুরাণে রাধার উল্লেখ নেই। 'গাথাসপ্তশতী'তে আনুমানিক খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের আগে রচিত অপভ্রংশ-প্রাকৃত ভাষার একটি রাধা-কৃষ্ণ লীলাবিষয়ক পদের উপস্থিতি দেখে পণ্ডিতদের অনুমান, সেন-আমলের লোক বাংলাতেই রাধা প্রেমকথার প্রথম উদ্ভব ঘটেছিল।

প্রাকৃত প্রেমকে বৈষ্ণব কবিরা সহজেই আধ্যাত্মিকতার স্তরে উপনীত করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দ থেকেই বৈষ্ণব পদাবলির ধারা শুরু হয়। সেই সময় থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত অগণিত বৈষ্ণব কবির রচনায় বৈষ্ণবতত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে, বৈষ্ণব পদাবলি হয়ে উঠেছে বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সূত্রেই কবিরা রাধাকৃষ্ণের লীলাবর্ণনার আশ্রয় নিয়েছেন।

চৈতন্যপূর্বযুগের পদসাহিত্যে বৈষ্ণবচেতনা অপ্রতুল হলেও তাঁর পরবর্তীকালে এক বিশিষ্ট ধর্মীয় চেতনার সুষ্ঠু প্রকাশই পদাবলির মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। 'উজ্জ্বলনীলমণি', 'ভক্তিরসামৃত', 'উদ্ধবসন্দেশ', 'শ্রীকৃষ্ণ কর্ণামৃত', 'গোবিন্দলীলামৃত', 'বিদগ্ধমাধব, জগন্নাথবল্লভ' প্রভৃতি গ্রন্থের ভাবধারা, ঘটনাবিন্যাস চৈতন্যপরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের রচনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

প্রথাগত এই সংস্কারের মধ্যে পদগুলি রচিত হলেও বৈষ্ণব ধর্মের উপাসনা প্রেমধর্মেরই উপাসনা, যা মানুষে মানুষে পার্থক্যকে স্বীকার করে না, শত্রু-মিত্র ভেদ মানে না; তাই এর আবেদনও সর্বজনীন।

পদাবলির চণ্ডীদাস

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাস নামে অজস্র কবির নাম পাওয়া যায়। কবি-সাধক চণ্ডীদাস তাঁর পদাবলিতে সহজ সুরে ভাব-গভীর কথা শুনিয়েছেন। তাঁর কোনো পদই সুস্পষ্টভাবে কোনো রসপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাঁর রচিত পূর্বরাগের পদে আত্মনিবেদনের সুর কিংবা বিরহের স্তরে বিরহোত্তীর্ণ অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায়। আক্ষেপানুরাগের পদ রচনায় তাঁর অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব।

তাঁর রচিত পদগুলিতে পূর্বরাগ পর্যায়ে আত্মহারা রাধাচিত্র যেমন উদ্ভাসিত, তেমনই কৃষ্ণচরিত্রের আকুলতাও প্রস্ফুটিত। 'বাসকসজ্জা' পর্যায়ে মিলন ঔৎসুক্য, হাহাকার, বেদনা, 'খন্ডিতা' পর্যায়ে বঞ্চনার ক্ষোভ, আক্ষেপানুরাগে কৃষ্ণপ্রেম পরিপূর্ণভাবে না পাওয়ার নৈরাশ্য ঘুচে গিয়ে 'নিবেদন' পদে চণ্ডীদাসের রাধা নিজেকে সম্পূর্ণভাবে কৃষ্ণের পদে সমর্পণ করেছেন। 'মাথুর' পর্যায়ে আবার রাধার বিরহ-যন্ত্রণার চিত্রায়ণ ঘটেছে। 'ভাবসম্মিলন' স্তরেও রাধার মনে দুঃখের স্মৃতি। চণ্ডীদাস মূলত বিরহেরই কবি। বিষাদের করুণ রাগিণীই তাঁর কাব্যবীণায় বেজেছে মরমী সুরে।

পদাবলির বিদ্যাপতি

'বিদ্যাপতি' একাধিক কবি পণ্ডিতের নাম অথবা উপনাম। বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতি বিহারের অন্তর্গত দ্বারভাঙ্গা জেলার (অধুনা মধুবনি মহকুমা/মিথিলা) বিসফি গ্রামে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন।

আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তাঁর তিরোধান হয়। তিনি রাজা শিবসিংহের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। কুলধর্মে শৈব বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদ রচনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র এবং স্মৃতিশাস্ত্রে তাঁর প্রশ্নাতীত অধিকার ছিল। সংস্কৃত ব্যতীত স্থানীয় উপভাষা অবহটঠেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

তাঁর নামাঙ্কিত প্রথম রচনা কীর্তিলতা লেখা হয়েছিল রাজা কীর্তিসিংহের আমলে। বইটি অবহটঠ ভাষায় লেখা গদ্যে-পদ্যে গ্রথিত একটি ঐতিহাসিক কাব্য। বিষয় কীর্তিসিংহের কীর্তি, পৈতৃক রাজ্যখণ্ড উদ্ধার। পরবর্তী কালে তাকে নিয়ে অনেক সেরা বাংলা উপন্যাস রচিত হয়েছিল। তাঁর পরবর্তী রচনা সংস্কৃতে লিখিত ভূপরিক্রমা (অপ্রকাশিত) কীর্তিসিংহের আত্মীয় দেবসিংহের আশ্রয়ে।

দেবসিংহের পুত্র শিব সিংহের আশ্রয়ে লেখা হয়েছিল সংস্কৃতে ও অবহটঠে লেখা কীর্তিপতাকা (অপ্রকাশিত) এবং লৌকিক ও ঐতিহাসিক কাহিনিগ্রন্থ 'পুরুষ পরীক্ষা'। 'পুরুষ পরীক্ষা' রচনা শেষ হওয়ার আগেই শিব সিংহের মৃত্যু হয়। দ্রোণবারের রাজা পুরাদিত্যের আশ্রয়ে বিদ্যাপতি সংস্কৃতে পত্রদলিল 'লিখনাবলী' লিখেছিলেন। এছাড়াও তাঁর নামে 'গঙ্গাবাক্যাবলী', 'দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী' প্রভৃতি গ্রন্থের পরিচয় পাওয়া যায়।

তবে পদাবলির কবি হিসাবেই তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধি। চৈতন্যদেব তাঁর পদ অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে শুনতেন। বাঙালি বৈষ্ণব পাঠক ও কবিদের কাছেও তাই তিনি স্মরণীয়। শুধু গানে ব্যবহৃত একপ্রকার কৃত্রিম ভাষায় বিদ্যাপতি পদ রচনা করেছিলেন। এ ভাষা পরবর্তী সময়ের বহু কবিকে আকৃষ্ট করেছে এবং বৈষ্ণব পদে নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। এমনকি কিশোর রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে বজ্রবুলি ভাষার অনুবর্তন ঘটিয়েছেন।

বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক প্রায় আটশো পদ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচনায় জয়দেবের অনুসরণ লক্ষ করে তাঁকে 'অভিনব জয়দেব' অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাঁর পদাবলির বাংলা অনুবাদ করে কবিরঞ্জন 'ছোটো বিদ্যাপতি' অভিধায় ভূষিত হয়েছেন।

বাঙালি তিনি ছিলেন না, বাংলাতে পদও তিনি রচনা করেননি, তবু তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ হল এই যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই তাঁর উৎকৃষ্ট পদের সঙ্গে বাঙালির পরিচিতি, রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা নির্ভর রচনার প্রতি বাঙালির অন্তরের টান, পরবর্তীকালে বাঙালি কবিসমাজে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পদরচনার প্রবণতা। বৈষ্ণব পদাবলির বিভিন্ন রসপর্যায় যেমন, বয়ঃসন্ধি, অভিসার, মিলন, মান, মাথুর, ভাবসম্মিলন প্রভৃতির পদরচনায় তিনি অনবদ্য ছিলেন।

মিথিলারাজ শিবসিংহের সুহৃদ এই কবি ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ, স্মৃতি-শাস্ত্র-সংহিতায় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত। কবি জয়দেবের ভাবাদর্শ, রচনারীতি, সংস্কৃত কবিতা এবং ভাগবতের লীলাকাহিনির প্রভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বৈষ্ণব পদ রচনা করেন।

এছাড়া তাঁর রচনার মধ্যে রয়েছে 'শৈবসর্বস্বহার', 'বিভাসাগর', 'দানবাক্যাবলী', প্রভৃতি। বারংবার মুসলিম আক্রমণে বিপর্যস্ত মিথিলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের রাজ-অর্পিত দায়িত্ব বিদ্যাপতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কর্ণধার ও শৈব বংশোদ্ভূত হলেও শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি মতের প্রতি তাঁর সমদর্শিতার পরিচয় মেলে।

ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, 'শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব-মতের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল বলে তাঁকে পঞ্চোপাসক হিন্দু (শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য) বলেই গণ্য করতে হবে।' বিদ্যাপতি মৈথিলি ভাষায় বৈষ্ণবপদ রচনা করলেও তাঁর রচনায় বহু বাংলা শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই মৈথিলি-বাংলার মিশ্রণে গড়া ভাষাই হল ব্রজবুলি।

পরবর্তীকালের বহু কবি এই কৃত্রিমভাষা ব্রজবুলিকে পদরচনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। পূর্ব-ভারতের শীর্ষস্থানীয় এই কবির ভাবধারার সুযোগ্য অনুসৃতি চৈতন্য পরবর্তীকালের বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস কবিরাজের রচনায় লক্ষ করা যায়। তাই বাংলায় বহু পদকারের রচনায় বিদ্যাপতির রচনার প্রভাব থাকলেও তাঁকেই 'দ্বিতীয় বিদ্যাপতি' আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

ব্রজবুলি ভাষা প্রসঙ্গে

অন্ত্য-মধ্য বাংলা ভাষায় বাংলা-মৈথিল-অবহটঠ মিশিয়ে একটি বিশেষ ভাষা পাওয়া গিয়েছিল। মিথিলার কবি উমাপতি ওঝার গীতিনাট্য 'পারিজাতহরণে' এর প্রথম লিখিত নমুনা পাওয়া যায়। এই ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিদ্যাপতিকেই মনে করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, 'ব্রজবুলি' আর 'ব্রজভাষা' এক নয়। ব্রজভাষা মথুরার ভাষা।

আর ব্রজবুলি হল একটি মিশ্র, কৃত্রিম ভাষা। এয়োদশ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষ পর্যন্ত মিথিলায়, বাংলায়, ওড়িশায় এবং আসামে ব্রজবুলির চর্চা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে চৈতন্যপরবর্তী বৈষ্ণব পদকর্তারা ক্রমাগত এ ভাষায় পদরচনা করেছেন। এই ভাষার ধ্বনিমাধুর্য এবং পদাবলির প্রতি বাঙালির চির-আকর্ষণের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের গোড়ার দিকে 'ভানুসিংহের পদাবলী' লেখেন।

নমুনা: 'হাথক দরপণ মাথক ফুল।
নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।।
হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার।
দেহক সরবস গেহক সার।।'
                        (বিদ্যাপতি)

পদাবলির জ্ঞানদাস

বৈষ্ণব পদাবলি রচয়িতা জ্ঞানদাস ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে বর্ধমান জেলার কাঁদড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কবি চণ্ডীদাসের কাব্যধারার উত্তরসূরি এই কবি অনুরাগ ও 'আক্ষেপানুরাগ'-এর পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাঁর রচিত পাঁচশোর বেশি পদে ভাবের গভীরতা, ঘটনা সংস্থান সৃষ্টির মৌলিকতা যেমন বিস্ময়কর, তেমনই যথাযথ অলংকরণ ও মন্ডনকলাও ঈর্ষণীয়।

চৈতন্যোত্তর যুগের নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে বৈষ্ণবতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর সুগভীর জ্ঞানের পরিচয় তাঁর বাংলায় রচিত পদগুলিতে পাওয়া যায়। বাসকসজ্জা, খন্ডিতা, কলহান্তরিতা পর্যায়ের বহু পদ তিনি ব্রজবুলি ভাষাতে রচনা করলেও তা বাংলায় রচিত পদগুলির মতো রসোত্তীর্ণ হতে পারেনি। রচিত পদগুলির লিরিকধার্মিতায় অর্থাৎ গভীর অনুভূতির আকুতিকে সংহতও তীব্র আকারে প্রকাশ করার বৈশিষ্ট্যে তিনি অনন্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেমানুভূতিকে তিনি কাব্যভাষায় যথার্থ লিরিকধর্মী করে তুলেছেন যা সকলের কাছেই পরম আস্বাদ্য হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence