‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে..’ যেভাবে ঈদ আনন্দের প্রধান অনুষঙ্গ

  © সংগৃহীত

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, গানটি বাংলাদেশে রীতিমতো যেন ঈদ উৎসবের জাতীয় সঙ্গীত অথবা ঈদের দিনের আবহ সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা গেছে এমন ঘোষণার সাথে সাথেই পাড়ায় মহল্লায় প্রথমেই শোনা যায় হৈ হুল্লোড়।

আর তার পরপরই টেলিভিশন ও রেডিওতে বাজতে শুরু করে এই গানটি। অনেকের কাছেই এই গানটি না বাজলে ঠিক ঈদ বলে মনে হয়না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বুশরা ফারিজমা হুসাইন বলছেন, ‘গানটি না শুনলে মনেই হয় না যে ঈদ শুরু হয়েছে’।

ইশরাত জাহান বলছেন, এই গান নিয়ে তার রয়েছে অনেক স্মৃতি। ‘কাজিনদের সাথে গানটি শুনতে শুনতে রীতিমতো নাচতাম আমরা" কিন্তু কোথায় এই গানটির যাত্রা শুরু? আর কিভাবে তা বাংলাদেশে ঈদ আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠলো?

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানটি লিখেছিলেন ১৯৩১ সালে জনপ্রিয় শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমেদের অনুরোধে। যা আজ থেকে প্রায় ৮৯ বছর আগে। সেই গল্পই করছিলেন তার ছেলে শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসি।

তিনি বলছেন, ‘আব্বা নজরুলকে বলতেন কাজিদা। তিনি একদিন বললেন কাজিদা এই যে পেয়ারু কাওয়াল ঈদের সময় কত সুন্দর গান রচনা করে আর এইচএমভি থেকে যখন গ্রামোফোন বের হয়, হাজার হাজার কপি মুসলমানরা কিনে নেয়। তুমি এরমক একটা গান লেখো না?’

বাবার স্মৃতিকথা থেকে গানটি সম্পর্কে গল্প করছিলেন
 মুস্তাফা জামান আব্বাসি

আব্বাসউদ্দিন বয়সে একটু ছোট হলেও দু জনের সম্পর্ক বন্ধুর মতোই ছিল। আব্বাসউদ্দিন আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন সেই সময়কার রেকর্ড কোম্পানি এইএমভির কর্মকর্তা ভগবতী ব্যানার্জি তখন বলেছিলেন, মুস্তাফা জামান আব্বাসির ভাষায়, ‘তিনি বললেন আব্বাস সাহেব মুসলমানদের পয়সা নেই। তারা রেকর্ড কিনতেও পারবে না। পুঁজোর সময় গান বিক্রি হয়। ঈদের সময় কোন গান বিক্রি হবে না।’

ছেলের ভাষায়, নাছোড়বান্দা আব্বাসউদ্দিন রাজি করিয়েছিলেন সে সময়কার এইচএমভি কোম্পানির ভগবতী ব্যানার্জিকে। গানটি এরপর এক বসায় লেখা ও সুর করা। তিনি বলছিলেন, ‘নজরুল আব্বাকে বললো পান নিয়ে আসো আর চা। আব্বা অনেকগুলো পান নিয়ে এলো। আর বললো চা আসছে। নজরুল একটা কাগজ নিয়ে এই গানটি লিখলেন। তারপর বললেন সুরটা এখনই করি না পরে করবো?’

আব্বাসউদ্দিন বললেন, কাজিদা আপনার মনের যে অনুভূতিটা, যেটা গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন এখন না করলে সেই মজাটা হবে না। এই সেই ইতিহাস, গানটি প্রথম গেয়েছেন আব্বাসউদ্দিন নিজেই। লেখার কদিন পরেই রেকর্ড করা হয়েছিলো।

কবি নজরুলকে নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম গবেষণা শুরু করেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সেসময়কার বাঙালী মুসলিম সমাজ এই গানটি তখন লুফে নিয়েছিল। তিনি বলছেন, ‘অন্য এলাকায় মুসলিমরা গান করলেও বাঙালী মুসলিমের কাছে সঙ্গীত ছিল অপাঙতেও। কিন্তু এই গানটিতে ধর্মীও ভাবধারা আর ঈদের যে খুশি সেটা খুব চমৎকারভাবে ধরা পরেছে।

সেই থেকে এই গানের শুধু উত্থানই হয়েছে। এমনকি অমুসলিম শিল্পী সতিনাথ মুখার্জিসহ আরো অনেকের কণ্ঠে শোনা গেছে গানটি। আব্বাসউদ্দিনের ছেলে ও মেয়ে মুস্তাফা জামান আব্বাসি ও ফেরদৌসি রহমানও গানটি জনপ্রিয় করেছেন। কিন্তু গানটিকে ধীরে ধীরে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার।

ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই এই গানটি বাজানোর একটি রীতি প্রচলন করেছে সরকারি এই দুটি সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান, বলছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তবে মুস্তাফা জামান আব্বাসি বলেন, গানটি আসলে জনপ্রিয় করেছে বাংলার মুসলমান।

তিনি আরো বলছেন, ‘আব্বাস উদ্দিন মারা গেছেন ১৯৫৯ সালে। তার পরে এত বছর গানটি কারা গাইলো? আমরাইতো গাইলাম। আব্দুল আলিম, আব্দুল হালিম চৌধুরী, বেদার উদ্দিন আহমেদ, সোহরাব হোসেন, এদের নাম আমরা ভুলে যাবো কেন?’

আর অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, এই গানটি দিয়েই বাংলায় মুসলিমদের মধ্যে সঙ্গীতের জনপ্রিয়তার শুরু, শোনা ও চর্চার শুরু। তিনি বলছেন, নজরুলই তার সূচনা করেছেন।

এরপর ইসলামের নানা দিক ও ঈদকে নিয়ে গান রচনার চেষ্টা আরো অনেকেই করেছেন কিন্তু তাতে এতটা সফল কেউই হননি, বলছিলেন অধ্যাপক ইসলাম। সূত্র: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ