প্রশাসনে রদবদল হয়, ভাগ্য বদলায় না ইবির বকুলের
- ইবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৫ PM , আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:২৫ PM

‘আনুমানিক ১০ বছরের মতো সময় ধরে এখানে কাজ করছি। প্রথমে স্যাররা পকেট থেকে ৭০০ টাকা বেতন দিত, এরপর ২০০০ হলো। আসকারী স্যারের সময়ে কিছুদিন ডে-লেবার হিসেবে বরাদ্দের টাকা পেলেও সালাম স্যার এসে ছয় মাস পরে বন্ধ করে দেন। প্রতিবার আশায় থাকি ইনি এলেই হবে, উনি এলেই হবে, কিন্তু হয় না। যদি আমার ফাইলটা পাস হতো, তাহলে অন্তত সংসারটা একটু চালাতে পারতাম।’
এভাবে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রকাশনা ও জনসংযোগ দপ্তরের পিয়ন পদে বিনা বেতনে কাজ করে যাওয়া বকুল হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য, প্রকাশনা ও জনসংযোগ অফিসে ২০১৩ সালের ১ জুন থেকে বিনা পারিশ্রমিক/বেতনে পিয়নের কাজ করে আসছিলেন বকুল। পরে তৎকালীন উপাচার্যের অনুমোদন সাপেক্ষে ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দৈনিক মজুরিতে 'ডে-লেবার' হিসাবে কাজ করেন। ২০২১ সালের মে থেকে তার দৈনিক মজুরি বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরি, ক্যালেন্ডার, জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন ও ৮টি অনুষদের জার্নাল সংক্রান্ত চিঠিপত্র-প্রজ্ঞাপন এবং প্রকাশিত ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও বার্তা বিভিন্ন অফিসে প্রেরণ, কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেস ক্লিপিং প্রেরণ, ফটোকপি মেশিন অপারেটিং কাজসহ অফিসের সংশ্লিষ্ট সব কাজ একটানা দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষতার সঙ্গে সামলে আসছেন বকুল। সারা দিনে এত কাজ করলেও আদতে যেন কিছুই করেন না তিনি। মাস শেষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বেতন তো পানই না বরং জনসংযোগ দপ্তরের কর্মকর্তাদের পকেট থেকে দেওয়া ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকার যৎসামান্য অর্থ তার অভাব যেন আরও বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ায় জনসংযোগ দপ্তরের নিয়মিত কাজ সম্পাদনে কর্মচারী/পিয়নের সংকট দেখা দিয়েছে। দাপ্তরিক কাজ চালু রাখতে বাধ্য হয়ে বকুল হোসেনকে খাটাতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের।
অন্যদিকে এত দিন ধরে কাজ করে যাওয়ায় বকুল হোসেনও স্থায়ী চাকরির আশায় বুক বেঁধেছেন। আসকারী প্রশাসনের আমলে আড়াই বছর ‘ডে-লেবার’ হিসেবে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি পেলেও সালাম প্রশাসন এসে ছয় মাস পরেই তার বেতন বন্ধ করে দেয়। ২০২১ সালের মে মাস থেকে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি টাকাও মজুরি পাননি বকুল।
বকুলের বাসা কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে। স্ত্রী ও দুই মেয়ের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা তার। প্রতিদিন ভোরে উঠে খাওয়াদাওয়া করে এক ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে শহরের বড়বাজার আসেন তিনি। এরপর সেখান থেকে শহরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে অফিসে আসেন।
সংসার কীভাবে চলে জানতে চাইলে বকুল বলেন, খুবই কষ্ট করে জীবন কাটে আমার। মাসিক ইনকাম আনুমানিক ৮ হাজারেরও কম। পিতৃসূত্রে পাওয়া এক বিঘা জমিতে ধান, পেঁয়াজ চাষ করি। সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ আর মাঝেমধ্যে স্যারদের কাছে ছুটি নিয়ে চাষাবাদের কাজ করি। সংসার চলে অনেকটাই আমার বউয়ের জন্য। বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু আছে। সে সব দেখাশোনা করে। এসব থেকেই কোনোভাবে। আমাদের খাওয়া-পরা, মেয়েদেরও পড়ালেখার খরচ চালানো হয়। মেয়েদের বই কেনার সময় কারও কাছে টাকা চাইলে দেয়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বকুল বলেন, সবচেয়ে কষ্ট লাগে তখন, যখন আমি বাসায় গেলে আমার ছোট মেয়েটা ব্যাগটা খুলে দেখে কোনো খাবার নিয়ে গেছি নাকি। কিন্তু আমি নিয়ে যাইতে পারি না। বড় মেয়েটা ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। অটোতে ১০ টাকা ভাড়া হওয়ায় যে পর্যন্ত ৫ টাকা ভাড়া, সেখানে নেমে বাকি পথ হেঁটে যায়। এই কষ্টের কথা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। স্যারদের বলার পরও তারা বোঝেন না।
এতদিন ধরে বিনা বেতনে খাটছেন কেন, জবাবে বকুল বলেন, প্রতিবার আশায় থাকি ইনি আসলে হবে, উনি আসলেই হবে। কিন্তু হয় না। যদি আমার ফাইলটা শুধু পাস হতো, তাহলে অন্তত সংসারটা চালাতে পারতাম ঠিকভাবে। আমরা ডে লেবার ঢুকেছিলাম একসঙ্গে সাতজন। ডরমিটরির তিনজনের কাজ হয়েছে। তাদের এখন ১৬ হাজার টাকা বেতন কিন্তু আমার হয়নি।
এ বিষয়ে তথ্য, জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের উপ-রেজিস্ট্রার সাহেদ হাসান বলেন, অফিস সহকারী বা পিয়ন পদে আমাদের জনবল ছিল না। যিনি ছিলেন, তিনি মারা যান। বকুল কিছুদিন ডে-লেবার হিসেবে কাজ করলেও হঠাৎ তা বন্ধ হয়ে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আমাদের পকেট থেকে দেওয়া ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা কোনো টাকাই না। আমরা একাধিকবার প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রশাসন জিজ্ঞেস করেছিল যে এর আগে কীভাবে চলত। আমরা জানিয়েছিলাম যে আমরা পকেট থেকে টাকা দিয়ে চালাতাম, তখন প্রশাসন বলে আগে যেভাবে চালাতেন, সেভাবে চালান। কিন্তু এটা তো কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না। আমরা চাই ডে-লেবার হিসেবে ও যে টাকাটা পেত, সেটা যেন প্রশাসন আবারও চালু করে বকুলের জীবনধারণকে আরেকটু সহজ করে দেয়।
জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক ড. আমানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম এই তথ্য প্রকাশনা ও জনসংযোগ অফিসে বিগত কোনো প্রশাসনই তেমন নজর দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচার এবং বার্তা প্রকাশসহ প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই অফিস করলেও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন অফিসে চিঠি পাঠাতে পিয়ন দরকার কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরে এখানে কোনো পিয়ন নেই। আমাদের পকেট থেকে পয়সা দিয়ে বকুলকে কাজ করাতে হয়। তার থোকের বিষয়ে আসকারী প্রশাসনকে বলছিলাম অন্তর্ভুক্ত করতে। ৮০ জনের থোক বরাদ্দ হলেও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে তাকে থোকভুক্ত করা হয়নি। পরের প্রশাসনও একই কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, লোকবলের অভাবে আমাদের ডেইলি ইভেন্ট কাভার দিতে হিমশিম খেতে হয়। আমরা বর্তমান প্রশাসনকেও অবগত করেছি, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ সবাইকে জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি দ্রুত দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।