দুই সন্তান নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করেন সাওদা, মাসিক আয় হাজার ডলারের বেশি
বিবি সাওদা। ভোলা সদরেই জন্ম তার, এখানেই বড় হওয়া স্কুল কলেজ সবকিছু। ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ভোলা সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। কাজ করছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পেয়েছেন ‘ন্যাশনাল ফ্রিল্যান্সার কনফারেন্স ২০২৩’-এ সম্মাননা। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস
২০০৫ সালে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী সেনাবাহিনীতে সার্জেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। এখন অবসর গ্রহণ করেছেন। আমার দুইটি ছেলে সন্তান রয়েছে। বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট।
২০১৫ সালে আমার পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর প্রথম সন্তান হলে আমি বাবার বাড়িতেই ছিলাম। তখন একা একা সময় কাটতো না। একজনের কাছ থেকে জানতে পারি অনলাইনে ঘরে বসে এভাবে আয় করা সম্ভব। তখন আমি সরকারিভাবে যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বেসিক কম্পিউটার কোর্স নেই কারণ আমি কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কে জানতাম না। গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর একটা কোর্সে আসলে আমি সেই কোর্সটি করি। তারপর ৪ মাসের এডভান্স কোর্স করি গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর। এরপর ২০১৮ সালে মার্কেটপ্লেসে আমার একাউন্ট তৈরি করা হয়। সেখানে আমি একটা অর্ডার পাই পাঁচ ডলারের। তখনো আমি শিখছিলাম। সে অবস্থায়ই আমি আমার প্রথম কাজটি পাই। তখন নতুন থাকায় খুব বেশি কিছু বুঝতাম না।
আমার অনেক অর্ডার ক্যান্সেল হয়ে যেত। তখন একটা খারাপ লাগা কাজ করতো যে কাজটি পেলাম না। আমার মনে আছে একবার আমি একটা ২০০ ডলারের কাজ পাই। আমি সেটার জন্য দিন-রাত খাওয়া বন্ধ করে কাজ করতে থাকি কিন্তু বায়ারটা প্রতারক থাকায় আমার কাজগুলো নিয়ে অর্ডার ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো। তখন আমার মনে খুব বাজে একটা প্রভাব পরে আমি ভেবেছিলাম ফ্রিল্যান্সিং ছেড়েই দিবো। তখন আমার মেন্টর, হাজবেন্ট তাদের কথায় আমি লেগে থাকি। তারপর ধীরে ধীরে আমি ১০০-২০০ ডলার এমন করতে করতে যখন লেভেল ওয়ান হয়ে যাই তখন প্রচুর পরিমানে আমার আয় শুরু হয়। ২০১৯ এবং ২০২০ সারে আমার সবচেয়ে বেশি আয় হয়। করোনাকালীন সময়ে সবাই বসে থাকলেও তখন আমার ভালো আয় হতে থাকে। দেখা যেত দুই থেকে আড়াই হাজার ডলারও আমার ইনকাম হয়েছিলো তখন। সে টাকা দিয়ে আমি একটি ফ্ল্যাট ও কিনি। ২০২২ সালে এসে আমার ছোট বাচ্চা হলে তখন আমি খুব একটা কাজ আগের মতো চালিয়ে যেতে পারছিলাম না। এবছর ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছি।
আমার শুরুটাই হয় গ্রাফিক্স ডিজাইনিং নিয়ে। আমার মনে হয় অন্যান্য সেক্টর থেকে আমার গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের স্কিলটা ভালো। আমি অন্যান্য অনেক সেক্টর যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইনিং, ভিডিও এডিটিং এগুলো ট্রাই করেছি কিন্তু আমার এখানেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ হচ্ছিলো। ডিজাইন করেতই আমার ভালো লাগে।
প্রথম আয়ের অনুভূতিটা বিশাল। কারণ সবাই এখানে পারে না। প্রথম যখন আমরা শেখা শুরু করি দেখা যায় একসাথে ১৫ জন শিখলেও সবার আগে আমিই কাজ পেয়েছিলাম। কাজটা মাত্র পাঁচ ডলারের হলেও অনুভূতিটা অনেক বেশি ভালো লাগার ছিলো। আমি খুশিতে সারারাত ঘুমাতেও পারিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি কাজটা জমা দিয়েছি বা ফাইভ স্টার রেটিং পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার ঘুমই আসেনি উত্তেজনায়।
আমার প্রথম বাচ্চাটা ছোট থাকায় অনেক সমস্যা হতো। দেখা যেত ওকে নিয়ে আমার রাতে জেগে থাকতে হতো। আবার দেখা যেত ঘুমানোর ক্ষেত্রেও অনেক সমস্যা হতো। তবে আমার পরিবার আমার প্রতি অনেক সাপোর্টিভ থাকায় আমি কাজ করে যেতে পেরেছি। আমার মা-বাবা থেকে শুরু করে আমার স্বামী শাশুড়ি সবাই। আমার প্রথম ল্যাপটপ কেনার ক্ষেত্রে আমার শাশুড়িই আমার স্বামীকে বোঝায় যে আমি এখানে ভালো করতে পারবো বা আমাকে দিয়ে হবে। কাজ শেখার জন্য টাকা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব সাহায্যই তারা করে।
এখানে ব্যর্থতার জন্য প্রথম কারণ হচ্ছে ধৈর্য্য না থাকা। যারা এখানে আসে তারা বেশিরভাগই আসে শুধুমাত্র টাকা কামানোর জন্য। ভাবে এখানে আসলেই ডলার আর ডলার। কিন্তু বিষয়টি আসলে তা নয়। একটা ভবন তৈরি করতে গেলে প্রথমে যেমন গাঁথুনি দিয়ে একটা বেস করে তৈরি করতে হয়। এখানেও প্রোফাইল তৈরি করতে গেলে একটা একটা রিভিউ দিয়ে পজিশন তৈরি করে আসতে হবে। অনেকে দেখা যায় দুই মাস কাজ শিখেই প্রোফাইল তৈরি করে এবং খুব একটা ভালো কাজ করতে পারে না বা করলেও অনেক কম টাকায় করে। এভাবে দেখা যায় যারা পুরাতন এবং স্কিলড ফ্রিল্যান্সার তার তাদের দামে কাজ পায় না। নতুনরা অনেক সময় কাজ না করে চলে যায় বা বাজে কাজ করে ফলে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের প্রতি একটি বিরূপ মনোভাব চলে আসে। এছাড়া এখন সময়ের সাথে সাথে আপডেটেড থাকতে হয় তা না হলে ভালো করা সম্ভব না। কারণ এখন এআইয়ের যুগ।
বাংলাদেশে থেকে আমাদের মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে খুবই সমস্যায় পরতে হচ্ছে। একটা হলো কাজ জমা দেওয়ার পর টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে। এ সমস্যাটি অনেক ঝামেলার মধ্যে ফেলে আমাদের। বর্তমানে আমরা পাইয়োনিয়ার দিয়ে অর্থ আনলেও দেখঅ যায় আমাদের অনেক কম ডলার রেটে টাকা দেয়। এছাড়া প্ল্যাটফর্ম ফি, ট্রান্স্যাকশন ফি এইসব দিয়ে আমাদের খুব একটা টাকা থাকেই না। দেখা যায় ১০০ ডলার আয় করলে ৩০-৪০ ডলার এখানেই চলে যায়। এসব কারণে অনেকে অবৈধ উপায়ে দেশে টাকা আনতে বাধ্য হয়। এছাড়াও দ্বিতীয় যে সমস্যা সেটা হলো বিদ্যুৎ। অনেক সময়ই কাজ করতে গেলে বিদ্যুৎ পাওয়া যায়না। বসে থাকতে হয়। সর্বশেষ ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতেই হয়। ইন্টারনেটের ধীর গতির ফলে আমরা অনেক কাজই করতে পারি না। আর শহর অঞ্চল বাদ দিয়ে বাকী সব জায়গায় এর অবস্থা অনেক খারাপ।
নতুনদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ আপনারা প্রতারিত হবেন না। শেখার ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই দেখে শুনে ট্রাস্টেড কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিখতে হবে। যে মেন্টর তার সেলার একাউন্ট আছে কিনা। সে নিজে মার্কেটপ্লেসে কেমন কাজ করছে এমন দেখে শুনে তারপর যেতে হবে। অধিকাংশই এক দুইটা কাজ করে তার বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়ে নতুনদের প্রতারিত করে থাকে। তারপর তাদের এই কারণে মার্কেটপ্লেসের যে ক্ষতিটা হয় এই দায়ভার তো আর তারা নেয়না। এসব কারণে দেখা যায় যারা পুরাতন এই সেক্টরে ভালো অবস্থানে তাদের সমস্যা হয়। তাই বলবো এখানে আসতে হলে আগে থেকেই মাইন্ড সেট করে আসতে হবে। চাকরির পাশাপাশি এটা করবো বা এর পাশাপাশি অন্যকিছু করবো এভাবে আসলে এখানে বেশিদিন কিছু করা সম্ভব হয়না। এটা মুক্ত পেশা বলা হলেও এখানে যখন ইচ্ছা আসলাম যখন ইচ্ছা চলে গেলাম এমন না। আমার যখন বাচ্চা হয় হাসপাতাল থেকে এসেই আমাকে কাজের ডেলিভারিগুলো দিতে হয়েছিলো। তাই বলবো এখানে কাজ করতে হলে লেগে থাকতে হবে।