আলোচিত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪’-কে কেন কালো আইন বলা হয়?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২৫ PM , আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২৫ PM

মিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী অভিনেত্রী মেঘনা আলমকে ঢাকায় তার বাসা থেকে আটক করার দু-দিন পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালত তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) রাতে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালত এ আদেশ দেন। আটকের ঘটনার তিনদিন পর পুলিশ জানিয়েছে, মেঘনাকে সুনির্দিষ্ট কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে 'নিরাপত্তা হেফাজতে' রাখা হয়েছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। পাশাপাশি চলছে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪’কে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে মিথ্যাচার ছড়ানো মাধ্যমে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে তৈরি এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে উঠেছে নানামুখী বিতর্ক। তবে সে সময়ে আইনের এই প্রয়োগের বাস্তবতার কথাও বলছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ আইনটিকে কালো আইন বলেও উল্লেখ্য করছেন।
বিশেষ ক্ষমতা আইন কী?
‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ বা ডিটেনশন আইন প্রয়োগ করে সরকার কোনও ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে। তবে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং তাকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ জানাতে হবে, এ তথ্য গণমাধ্যমকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।
‘তবে একজন নারীকে ধরার জন্য রাতের বেলা অর্ডার দিচ্ছে, বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। তার থেকে বড় কথা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এটি করতে পারবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কথা আইনে বলা নাই। তাহলে সিএমএম কোর্ট এটি কীভাবে করল?’ প্রশ্ন ওই আইনজীবীর।
আইনে সিএমএম কোর্টের এই অনুমতি দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই, বলেন তিনি। ইশরাত হাসান বলেন, ‘আইন ব্যত্যয় করে যদি কাউকে অ্যারেস্ট করে, তাহলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।’
‘বিস্তারিত অর্ডারে যদি দেখা যায় যে আইন বহির্ভূতভাবে তারা এটা করছে, তাহলে ইমিডিয়েটলি তাকে রিলিজ করা উচিত। দ্বিতীয়ত, অবৈধ ডিটেনশনের জন্য জড়িতদের তখন আইন বহির্ভূতভাবে একজনকে ধরায় প্রফেশনাল মিসকন্ডাক্টের আওতায় আনা উচিত’ বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী ইশরাত হাসান।
তার মতে, ‘মামলা থাকাবস্থায় কাউকে গ্রেফতার করা এবং মামলা নাই‒এমন কাউকে গ্রেফতার করা আলাদা বিষয়। এখানে স্পষ্টভাবে বলা নেই যে উনি দেশের বিরুদ্ধে কী করছেন। এগুলোর মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে আনতে হবে যে, কেন দেশের জন্য এত হুমকিস্বরূপ হয়ে গেল‒একটি অনেক বড় বিষয়।’
ডিএমপি'র দেওয়া বিবৃতির বিষয়ে তিনি এও বলেন, ‘এই জিনিসটা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা ঘটলে এটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এটা নিয়ে কোনও লুকোচুরি করা যাবে না। এই বিবৃতি পর্যাপ্ত না। প্রিডিটেনশনের সময় বলছেন যে বাংলাদেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। পরে অন্য কোনও মামলা দিয়ে দিলে তো হবে না।’
এই আইনজীবীএ-ও বলেন, মেঘনা আলমকে আটকের সময় নারী কনস্টেবল ছিল না বা তাকে আটকের আগে তার মেডিকেল টেস্ট হয়েছে কিনা, এগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে, বাংলাদেশে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ‘কালো আইন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এর আগে বিভিন্ন সময় এই আইনটি অপসারণের দাবি উঠলেও কোনো সরকারই তা করেনি।
কালো আইন বলার কারণ হিসাবে আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেছেন, ‘এই আইনের অনেক অপপ্রয়োগ হয়। এই আইন বিচারবহির্ভূতভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে থাকে। এটি সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার’-এর পরিপন্থি।’
এই আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা বিরোধী কার্যকলাপ, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি সাধন, জননিরাপত্তা বিরোধী কাজ করা, জনসাধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-সহ নানা বিষয়।
এছাড়াও, জনগণের মধ্যে বা জনগোষ্ঠীর কোনও অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, দেশের আইন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা দেওয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থি কাজ করা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মূলত, পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফশিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সাথে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
কেন কালো আইন বলা হয়
‘বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ দেশের বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সংবিধান একজন নাগরিককে যে অধিকার দিয়েছে, সেটারও পরিপন্থি। আইনটির ২ (এফ) ধারায় রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত ব্যক্তিকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে তাকে আটক করা যাবে। ৩ নং ধারা অনুসারে সরকারকে অবহিত করার পরে তা অনুমোদিত না হইলে আটকাদেশের প্রদানের ৩০ দিনের বেশি আটক রাখা যাবে না।
তবে সরকার আটকের বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়ে ব্যক্তিকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে আটক করার এবং বাংলাদেশ ত্যাগ করার আদেশ দিতে পারবেন। তবে বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে বহিষ্কারাদেশ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ত্যাগ করিতে ব্যর্থ হইলে অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই আইনের ধারা-৯ এর অধীনে বিচারপতি কিংবা সমমান পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়ে একটি উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করে থাকে সরকার. যারা আটকের সম্পূর্ণ ব্যাপার তদারকি করে থাকে। সংবিধান ও ফৌজদারি আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বিধান থাকলেও এই আইনে শুধু আটকের কারণসমূহ সরকারের কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্য সর্বোচ্চ ১৫ দিন সময় দিয়েছে। ফলে ১৪তম দিনেও আটকের কারণ উল্লেখ্য না করলেও চলবে।
গঠিত উপদেষ্টা বোর্ড সরকারের কাছে আটক ব্যক্তি সম্পর্কে প্রতি ১৭০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। যদিও এই আইনে আটক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া অস্পষ্ট কিছু মেয়াদ উল্লেখ আছে তা থাকলেও এই ব্যাপারে কেয়ার করা হয় না।
অনেকেরই ধারণা, এই আইনের মাধ্যমে মানুষকে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা হয় এবং গুম করে ফেলার সহজ পথ দেখানো হয়েছে। ফলে বিগত সময়ে আয়না ঘরের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বিচারকার্যে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া প্রতিটি মানুষের অধিকার, তবে এই আইনের ধারা ১১(৪) অনুযায়ী কথিত অপরাধীকে আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থাও আছে।
এই আইনের ধারা-৩৪ এর বিধান অনুসারে আটকের নাম করে গুমের মতো কর্মকাণ্ডের বিচার চেয়ে দেশের যেকোনো আদালতেও কোনরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সব কিছুই আইনের অধীন জনকল্যাণে রাষ্ট্রের স্বার্থে সরল-বিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি এই আইনের ৩৪-ক ধারার অধীনে অপরাধীর বিচারের রায়ের পর শাস্তি নিশ্চিতে গুলি করে হত্যার বিধানও রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই করেছিলেন। সেই আইনে বা আইনের মারপ্যাঁচে এক ধরনের গুম করার সুযোগ রয়েছে। ৩ থেকে ১৪ ধারা পর্যন্ত আটকের কথা বলা আছে। ৫ ধারাতে বলা আছে কাউকে যখন আটক রাখা হচ্ছে সেই আইনে সরকার জানাতে বাধ্য না তাকে কোথায় রাখা হচ্ছে। সিস্টেমেটিক্যালি গুম করার একটা অপপ্রয়াস থেকে যাচ্ছে।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) আইন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (মাসুম) জানান, এই আইনে Preventive Detention নামের এক ধরনের বিনা বিচারে ৬ মাস পর্যন্ত আটক রাখার বিধান আছে। এটা সরাসরি এক্সিকিউটিভ আদেশের মাধ্যমে করা যায় কোন বিচারিক পদ্ধতি বা ছাড়াই। বরং এটার জন্য কোন জবাবদিহিতা নাই। এজন্যই এটাকে কালা কানুন বা Black Law বলা হয়।