শিক্ষায় অপ্রতুল বাজেট

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ স্বপ্ন অধরা রয়ে যাবে?

শিক্ষা বাজেট
শিক্ষা বাজেট  © টিডিসি ফটো

আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য শিক্ষাখাতে যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে গত বছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে ৬ হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অনুপাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
 
অন্যদিকে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

যদিও যেকোনো দেশের শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার পরামর্শ ইউনেস্কোর। দেশের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ তার চেয়েও অনেক কম। শিক্ষায় বরাদ্দের বিষয়টিকে ব্যয় হিসেবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

“শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ কখনও দৃশ্যমান নয়, অর্থাৎ আপনি এখান থেকে তাৎক্ষণিক কোন ফলাফল পাবেন না। তবে পৃথিবীতে যারা উন্নয়ন করেছে তারা সবাই কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। তাদের প্রবৃদ্ধি এবং সার্বিক উন্নয়নে তারা সেটির সুফল ও পেয়েছে। আমাদেরও তাই শর্ট টার্মে চিন্তা না করে দীর্ঘ পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা বাজেটে দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ডেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। শিক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি করা না গেলে উন্নত বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে। পাশাপাশি সরকারের ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে যাবার যে স্বপ্ন রয়েছে সেটির বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে।

শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, আমাদের শিক্ষায় বিনিয়োগে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় কম। দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ডেও আমরা অনেক পিছিয়ে। আবার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বরাদ্দ এখানে যুক্ত হওয়ার ফলে যে বরাদ্দ আমরা দেখে থাকি শিক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ তার চেয়ে অনেক কম। প্রাইমারি স্তর থেকে আমাদের এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ প্রাইমারিতে যাদের বেসিক ভালো হয় না পরবর্তীতে আমরা দেখি তারা ভালো করতে পারে না। আমি মনে করি, প্রাইমারি স্তরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন বেতন ভাতা বৃদ্ধি জরুরি। যাতে সেখানে ভালো শিক্ষকেরা যেতে আগ্রহী হন। যারা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কাজেই শিক্ষায় এখন থেকে বরাদ্দ বাড়ানো না গেলে পরবর্তীতে প্রবৃদ্ধি এবং অন্যান্য সূচকে আমাদের বড় হুমকির মুখে পড়তে হবে। 

“শিক্ষায় যদি আমরা বরাদ্দ বৃদ্ধি না করি, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে কীভাবে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব? এবারের বাজেটে আমরা দেখেছি প্রাইমারি শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা খুবই অপ্রতুল-ড. তাইবুর রহমান, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষায় বিনিয়োগের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ কোন দৃশ্যমান বিনিয়োগ নয়, অর্থাৎ আপনি এখান থেকে তাৎক্ষণিক কোন ফলাফল পাবেন না। তবে পৃথিবীতে যারা উন্নয়ন করেছে তারা সবাই কিন্তু শিক্ষায় বিনিয়োগ করেছে। এবং তাদের প্রবৃদ্ধি এবং সার্বিক উন্নয়নে তারা সেটির সুফল পেয়েছে। আমাদেরও তাই শর্ট টার্মে চিন্তা না করে দীর্ঘ পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন। আরেকটি মৌলিক সমস্যা হলো আমাদের উচ্চশিক্ষায়ও গবেষণায় বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ফলে বিভিন্ন সূচকে আমরা আরও পিছিয়ে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন:  মেধাবীদের দেশ ত্যাগের ফলাফল ভয়াবহ হবে: অধ্যাপক আবুল কাসেম

বরাদ্দ বাস্তবায়নের জন্য সুচিন্তিত পরিকল্পনার তাগিদ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, বলা হয়ে থাকে শিক্ষায় বরাদ্দ বাস্তবায়নের রেট অনেক লো, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তার জন্য কারণ উদ্‌ঘাটন না করে যদি আমরা বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে কিন্তু ফলাফল আসবে না। বরং এসকল ক্ষেত্রে সঠিক পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন দরকার। অন্তত যে মন্ত্রণালয় কিংবা বিভাগ বরাদ্দ বাস্তবায়ন করতে পারেনি, সেখানে বছরে দুইবার প্রতিটি প্রকল্প ভিত্তিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। কোথায় কত টাকা ছাড় হলো কিংবা কেন হলো না এখানে অগ্রগতি কতদূর এসব বিষয়ে যথাযথ স্বচ্ছতা নিয়ে আশা জরুরি, তবেই সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ফলাফল আনা সম্ভব। 

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ২০ শতাংশ হওয়া জরুরি। জিডিপির আকারে যা হবে ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক বছর জিডিপির আকারে বাজেট কমেছে। আবার বাজেট বরাদ্দ কমলেও দেখা যায় বিভিন্ন বিভাগ সেটির পূর্ণ ব্যবহারে ব্যর্থ হচ্ছে। 

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তাইবুর রহমানের সাথে কথা হয় শিক্ষায় অপ্রতুল বরাদ্দ নিয়ে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমাদের যারা শিক্ষক কিংবা সুধী সমাজ রয়েছেন তারা বিভিন্ন সভা সেমিনারে আমাদের শিক্ষায় বরাদ্দ কম এই বিষয়টি ফোকাস করার চেষ্টা করছি নিয়মিত। ইউনিসেফের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষায় মোট জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার জন্য পরামর্শ  দিয়েছি। শিক্ষায় যদি আমরা বরাদ্দ বৃদ্ধি না করি, তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে কীভাবে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব? এবারের বাজেটে আমরা দেখেছি প্রাইমারি শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা খুবই অপ্রতুল। 

আরও পড়ুুন: কোটা পদ্ধতি কি আগের মত ফিরবে? মানতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যদি দেখি সেখানেও মাত্র ৫ শতাংশ গবেষণার জন্য রয়েছে। বাকি বরাদ্দ কিন্তু বেতন ভাতা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্য। এই বরাদ্দ দিয়ে যদি গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিংয়ের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয় এটা অসম্ভব। গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিং না থাকার একটি বড় কারণ হলো শিক্ষায় অপ্রতুল বরাদ্দ। আমাদের কনসার্ন দুইটা, প্রথমত শিক্ষায় বরাদ্দ কম। আর দ্বিতীয়ত সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল যে টাকা দেয়া হচ্ছে সেটার পূর্ণ ব্যবহারে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। শিক্ষায় বরাদ্দের যে পরিমাণ দেখছি আমরা প্রকৃতপক্ষে সেটা প্রকৃত বরাদ্দ নয়। কারণ এখানে ক্যাডেট কলেজগুলো আছে, বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ আছে। অর্থাৎ আমরা যে টাকার পরিমাণ দেখছি সেটা প্রকৃতপক্ষে আরও কম। 

New Project - 2024-06-08T144849-165

অর্থনীতিবিদ ড. সায়মা হক বিদিশা

গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে বলেন, আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জন্য ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দ নির্ধারণ করেছেন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি (জুন-২৩ থেকে মার্চ-২৪) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়ন হার ৪৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর বাইরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ তাদের মোট বরাদ্দের ৪২ দশমিক ৫১ শতাংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। তবে শিক্ষায় সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। তাদের বাস্তবায়ন দক্ষতার হার মাত্র ৩৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এছাড়াও অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীনে মোট ৫৮টি প্রকল্পের ১৩টি প্রকল্পের কর্মকর্তারা কোনো টাকাই খরচ হয়নি। তখন বাকি প্রকল্পগুলোর আর্থিক খরচের অগ্রগতি ছিল মাত্র ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

“প্রাইমারি স্তরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে শিক্ষকদের বিভিন্ন বেতন ভাতা বৃদ্ধি জরুরি। যাতে সেখানে ভালো শিক্ষকেরা যেতে আগ্রহী হন। যারা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা

অধ্যাপক তাইবুর রহমান বরাদ্দকৃত বাজেটের পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতের তাগিদ দিয়ে বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা দেখছি আমাদের জিডিপি কমে যাচ্ছে, আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছি না। ডলার সংকটে আমাদের যারা বিদেশি কোম্পানি রয়েছে তারা লভ্যাংশ দেশে নিয়ে যেতে পাছে না। এমন পরিস্থিতিতে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা তুলনায় অনেক কম। তাই আমার মনে হয় কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা এখনকার প্রশ্ন নয়, এখনকার প্রশ্ন হল যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা আমরা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারছি কি না? না পারলে এটার পিছনে কারণ উদ্‌ঘাটন করা এই মুহূর্তে জরুরি। গত বছরে শিক্ষাখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সেটা কাজে লাগাতে পারিনি। রিভাইস বাজেটে কয়েকশো কোটি টাকা কমানো হয়েছে। তার মানে এখানে গভার্নেন্স ইস্যু আছে। একটা বিষয় হলো আমার যে টাকা প্রয়োজন সেটা আমি সঠিক ক্যালকুলেট করতে পারছি কিনা! যদি না পারি তার মানে হলো আমার প্ল্যানিংয়ে ভুল আছে। 

New Project - 2024-06-08T145244-272

অধ্যাপক ড. তাইবুর রহমান

তিনি আরও যোগ করেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যারা বরাদ্দ দেয়ার পরে অর্থ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। একইসাথে এখানে দুর্বলতা কোথায় সেটার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। কেন আমরা এই টাকা ব্যবহার করতে পারিনি। কিন্তু এই বছরের প্রেক্ষাপটে যে টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সেটা পূর্ণ এবং যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ভালো ফলাফল আসবে। 


সর্বশেষ সংবাদ