১৯৭৩-এর পর মার্কিন ডলারের রেকর্ড পতন, কারণ কী
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৮:১০ PM , আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৬ PM

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৯৭৩ সালের পর থেকে সবচেয়ে বাজে সময় পার করেছে মার্কিন ডলার। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা তাদের ডলারভিত্তিক সম্পদ বিক্রি করতে শুরু করেছেন, যা ডলারের ‘নিরাপদ মুদ্রা’ হিসেবে অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ডলার সূচক, যা পাউন্ড, ইউরো, ইয়েনসহ ছয়টি প্রধান মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান পরিমাপ করে এ বছরের প্রথমার্ধে ১০.৮ শতাংশ কমে গেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের থেমে থেমে শুরু হওয়া শুল্ক-যুদ্ধ এবং ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা নিয়ে তার আক্রমণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অর্থনীতিবিদরা প্রেসিডেন্টের নতুন ‘বিগ বিউটিফুল’ কর বিল নিয়েও উদ্বিগ্ন, যা বর্তমানে মার্কিন কংগ্রেসে আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এই প্রস্তাবিত আইনটি আগামী দশকে মার্কিন ঋণের পাহাড়কে ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পারে এবং সরকারি ঋণ নেওয়ার টেকসইতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে, ফলে মার্কিন ট্রেজারি মার্কেট থেকেও বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ সরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, সোনার দামও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, কারণ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলারের অবমূল্যায়নের আশঙ্কায় সোনায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
ডলারের কী হয়েছে?
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন বেশির ভাগ দেশের ওপর আমদানি শুল্ক বসায়, যা বিশ্ব অর্থনীতির প্রতি আস্থা হ্রাস করে এবং মার্কিন সম্পদের ব্যাপক বিক্রি শুরু হয়। ‘লিবারেশন ডে’ নামে ঘোষিত ওই দিনে শুল্ক ঘোষণার পর তিন দিনের মধ্যে শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর মূল্য থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি উধাও হয়ে যায়। একই সঙ্গে ইউএস ট্রেজারি বন্ডের দাম পড়ে যায় এবং সরকারের জন্য ঋণের খরচ বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে গোবিপ্রবির ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ
এরপর ৯ এপ্রিল ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য শুল্ক কার্যকর না করার ঘোষণা দেন (চীনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম)। যদিও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনা কিছুটা কমেছে, তবুও বিনিয়োগকারীরা ডলারভিত্তিক সম্পদে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন। গত মাসে ওইসিডি জানায়, তারা চলতি বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ২.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৬ শতাংশে এনেছে, যদিও মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
ট্রাম্পের নতুন কর বিল: ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’
এই বিল ২০১৭ সালের কর ছাড় অব্যাহত রাখবে, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ খাতে বরাদ্দ কমাবে এবং ব্যাপক ঋণ গ্রহণ করবে। যদিও এই বিল পাসে আগস্ট পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, রিপাবলিকানরা চাইছেন ৪ জুলাইয়ের আগেই বিলটি পাশ করতে। এই আইনটি পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের সীমা ৩৬.২ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কংগ্রেসনাল বাজেট অফিসের হিসাব বলছে, এতে ২০৩৪ সালের মধ্যে ফেডারেল ঋণ আরও ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়বে।
বর্তমানে ঋণের পরিমাণ মোট জিডিপির ১২৪ শতাংশ হলেও এই বিল পাস হলে তা আরও বেড়ে যাবে। বার্ষিক বাজেট ঘাটতি ২০২৪ সালের ৬.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ৬.৯ শতাংশ হতে পারে।
ট্রাম্পের ‘ইলন মাস্কস ডিপার্টমেন্ট অব গভার্নমেন্ট ইফিশিয়েন্সি’ খরচ কমাতে তেমন সফল হয়নি। শুল্কের মাধ্যমে কিছু রাজস্ব এলেও, তার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আমেরিকান ভোক্তাদের। ফলে, মুডি’স মার্কিন সরকারের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস করেছে, যা মার্কিন প্রবৃদ্ধিকে ধীর করেছে এবং ডলারের ওপর আস্থা নষ্ট করেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমাতে ট্রাম্পের চাপ ও বাজারের প্রত্যাশা (এবং ফিউচারস কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী সম্ভাব্য ২-৩ বার হার কাট) ডলারের মান আরও কমাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি বিনিয়োগের জন্য ‘কম আকর্ষণীয়’ হয়ে উঠছে?
ডলার দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল। যেমন ২০২৩ সালে মার্কিন অর্থনীতি বিশ্ব জিডিপির এক-চতুর্থাংশ হলেও, বিশ্ব বাণিজ্যের ৫৪ শতাংশই ডলারে হয়েছিল। অর্থনৈতিক প্রভাব আরও বেশি—বিশ্বের ৬০ শতাংশ ব্যাংক আমানত ডলারে, আন্তর্জাতিক বন্ডের ৭০ শতাংশও ডলারে। আইএমএফ বলছে, বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের ৫৭ শতাংশই ডলারে। এ বিশ্বাসের ভিত্তি হলো মার্কিন অর্থনীতি, অর্থবাজার ও আইনি কাঠামোর উপর আস্থা। কিন্তু ট্রাম্প তা বদলে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সর্বজনীন বদলির আন্দোলন স্থগিত
ব্যাংক জে সাফ্রা সারাসিনের প্রধান অর্থনীতিবিদ কার্সটেন জুনিয়াস বলেন, বিনিয়োগকারীরা এখন বুঝতে পারছেন যে তারা মার্কিন সম্পদে অতিরিক্ত নির্ভরশীল।
বর্তমানে বিদেশিরা ১৯ ট্রিলিয়ন ডলারের মার্কিন শেয়ার, ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ট্রেজারি বন্ড এবং ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের করপোরেট বন্ড ধরে রেখেছেন। যদি বিনিয়োগকারীরা এগুলোর পরিমাণ কমাতে থাকে, তবে ডলারের মান আরও নিচে নামবে।
তিনি বলেন, ‘মার্কিন সম্পদ আগের মতো আর নিরাপদ নয়।’
ডলারের পতনের প্রভাব কী?
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই মনে করেন, ডলারের ‘রিজার্ভ স্ট্যাটাস’-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ব্যয় বেড়ে যায়।
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান স্টিফেন মিরান বলেন, উচ্চ ডলার ভ্যালু আমাদের কোম্পানি ও শ্রমিকদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: জুলাই যোদ্ধার স্বীকৃতি পাচ্ছে কক্সবাজারে নিহত হওয়া রোহিঙ্গা কিশোর
যদিও নিম্নমানের ডলার থিওরেটিক্যালি মার্কিন পণ্যকে বিদেশে সস্তা করে এবং আমদানি ব্যয় বাড়ায় (ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমে), কিন্তু চলমান শুল্ক যুদ্ধের কারণে এসব প্রভাব বাস্তবে অনিশ্চিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দুর্বল ডলার ইতিবাচক হতে পারে, তাদের ডলারে নেওয়া ঋণের চাপ কমবে, যেমন জ্যাম্বিয়া, ঘানা বা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে।
এ ছাড়া দুর্বল ডলার পণ্যমূল্য বাড়াতে পারে, যা ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া বা চিলির মতো পণ্য রপ্তানিকারক দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
অন্য মুদ্রার অবস্থা কেমন?
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর থেকে, ডলারের পতন বিনিয়োগকারীদের পূর্বাভাস উল্টো প্রমাণ করেছে। অনেকে ভেবেছিলেন ট্রেড ওয়ারের ফলে বিশ্বের অন্য দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বস্তুত, ইউরোর দাম ১৩ শতাংশ বেড়ে $১.১৭ ছাড়িয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা এখন মার্কিন অর্থনীতির ঝুঁকির দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এ সময় জার্মানি ও ফ্রান্সের সরকারি বন্ডের চাহিদাও বেড়েছে।
আরও পড়ুন: শিক্ষকদের জুন মাসের বেতন কবে, জানাল মাউশি
ডলার দুর্বল হওয়ায় আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা ইউরোপিয়ান শেয়ারে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন। স্টক্স ৬০০ ইনডেক্স প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে ২০২৫ সালের শুরু থেকে। ডলারে হিসাব করলে এই মুনাফা দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। অন্যদিকে, মুদ্রাস্ফীতি জানুয়ারির ৩ শতাংশ থেকে মে মাসে কমে ২.৩ শতাংশে নেমেছে।
কার্সটেন জুনিয়াস বলেন, ‘ডলারের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে অবস্থান তাড়াতাড়ি হারাবে না, কিন্তু এতে বাধা নেই যে ডলারের আরও দুর্বলতা দেখা দিতে পারে, আমরা ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ আরও দুর্বল ডলার প্রত্যাশা করছি।’
সূত্র: আল-জাজিরা