৯ মাসে জুলাই আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর ৩৬ রাজনৈতিক হামলা 

পিআইবির বাংলাফ্যাক্ট টিমের বিশ্লেষণ 

মাসভিত্তিক হামলার সংখ্যা
মাসভিত্তিক হামলার সংখ্যা  © পিআইবি

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন ঢাকার একটি এনজিওর গাড়িচালক জসিম উদ্দিন হাওলাদার। এর ১০ দিন পর, ২৯ জুলাই হাসপাতালে মারা যান তিনি। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকীতে দাফন করা হয় তাকে। তার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে গত ১৮ মার্চ ধর্ষণের শিকার হন শহীদ জসিমের ১৭-বছর-বয়সী মেয়ে। দীর্ঘ মানসিক পীড়নে ভোগার পর মেয়েটি গত ২৬ এপ্রিল ঢাকার শেখেরটেকের ভাড়া বাসায় আত্মহত্যা করেন। দৈনিক সমকাল এ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শহীদ জসিমের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রতিবেদককে বলেন, “দুর্বিষহ ঘটনার পর মেয়েকে একলা ছাড়িনি। এতদিন লগে লগে রাখছি। জামাই গেল, মাইয়ারেও বাঁচাইতে পারলাম না।” 

এর ঠিক পরদিন নোয়াখালীর মাইজদীতে জুলাই আন্দোলনের আরেক শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভীর ছোটভাই ১৬-বছর-বয়সী শাহরিয়ার হাসানকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। হামলার ঘটনা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নোয়াখালী জেলা সমন্বয়ক আরিফুল ইসলামের দৈনিকটিকে বলেন, কিশোর গ্যাংটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক রয়েছে।

শহীদ জসিম এবং শহীদ রিজভীর পরিবার একা নন। ৫ আগস্টের পর থেকে বিগত ৯ মাসে কমপক্ষে ৩৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকা ব্যক্তি অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপরে। 

আজ রবিবার (৪ মে) প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-‘র ‘বাংলাফ্যাক্ট টিম’ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার, আহত ও তার পরিবারের সদস্য এবং অংশগ্রহণকারীদের উপর হামলা, নিপীড়নের একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষণটিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

‘বাংলাফ্যাক্ট টিম’ গত নয় মাসে বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, এ ৩৬টি ঘটনার মধ্যে ৩৩টি আন্দোলনে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সাথে ঘটেছে এবং বাকি ৩টি জুলাইয়ে শহীদ পরিবারের সঙ্গে ঘটেছে। উল্লেখ্য, এ ঘটনার বাইরে আরও হামলার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি অথবা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও গবেষণা সীমাবদ্ধতার কারণে ফলাফলে উঠে আসেনি। 

শহীদ পরিবারের সাথে ঘটা তিনটি হামলার মধ্যে শাহরিয়ার হাসানের ওপর হামলা ছাড়া বাকি ২টি ঘটনার ক্ষেত্রে হামলাকারীদের সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

এছাড়াও জুলাইয়ের শহীদদের কবরে হামলার একাধিক ঘটনার গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন গত ২৬ এপ্রিল ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকা শহীদ ফয়জুল ইসলাম রাজনের কবর ভাঙচুর করা হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ অনুযায়ী, এ ঘটনায় শ্রমিকদলের একজন নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এর আগে গত ১৪ মার্চ কেরানীগঞ্জেই শহীদ সায়েমের কবর ভাঙচুর করা হয়, যেখানে শহীদের মা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলামকে দায়ী করেন। 

৩৬টি হামলার সাথে জড়িতদের সবচেয়ে বড় অংশ আওয়ামী লীগ অথবা এর অঙ্গসংগঠনের (ছাত্রলীগ/যুবলীগ) নেতাকর্মীরা। ৩৬টি ঘটনার মধ্যে ১৩টিতেই তাদের যোগ ছিল। যেমন গত জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করে পুলিশে দেওয়ার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কের ওপর হামলা করে দলটির নেতাকর্মীরা। প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সময় দুইজন সাংবাদিকও আহত হন। 

একইভাবে গতবছরের ডিসেম্বরের ২১ তারিখ ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মোবারক হোসেন অভিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর পর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ নোমানকে গ্রেফতার করা হয়।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর পরেই আছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। তারা মোট ৯টি ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন। যেমন: গত ১৬ এপ্রিল স্থানীয় বিরোধের জের ধরে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবুকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে গড়াইটুপি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। 

এদিকে মাত্র ৪ দিন আগেই বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা রিয়াদ হাসানকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে এক বিএনপি নেতার ছেলের বিরুদ্ধে। আহত রিয়াদ হাসান গাবতলী উপজেলার শালুকগাড়ী এলাকার বাসিন্দা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বগুড়ার যুগ্ম আহ্বায়ক। অন্যদিকে অভিযুক্ত সিফাত বগুড়া জেলা বিএনপির সদস্য ও পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফারুকের ছেলে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর হামলা বাদে আরো ৯টি হামলার ঘটনায় এখনো সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে হামলার ধরন ও পারিপার্শ্বিক আলামত দেখে ধারণা করা যায়, হামলাগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হতে পারে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে হামলাকারীদেরকে সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত অথবা ছিনতাইকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক কবিরুল ইসলাম জয়কে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। জুলাই আন্দোলনে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় পুলিশের গুলিতে তিনি আহত হন। তাঁর চোখেও গুলি লাগে। চোখের চিকিৎসার জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। শুক্রবার রাতে বাড়ি ফেরার পথে রাত দুটার দিকে একজন তাঁর কাছে ফোন করে জানতে চান, তিনি কোথায় আছেন। সে সময় কবিরুল তাঁকে ঠাকুরগাঁও ফিরছেন বলে জানান। কবিরুল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নেমে অটোরিকশায় বাড়ির দিকে রওনা হলে পাঁচটার দিকে ভুল্লী এলাকায় পৌঁছালে দুইটি মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়।

এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্তর্বর্তী বিরোধের জের ধরে আরো ২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে খুলনা ও বরগুনাতে। গত ৩ জানুয়ারি খুলনার শিববাড়ি মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক গ্রুপের আক্রমণে আহত হন অন্য গ্রুপের ৮ জন শিক্ষার্থী। বরগুনাতেও সমন্বয়ক মীর নীলয়ের গ্রুপের হামলায় আহত হন সমন্বয়ক রেজাউল করিমসহ ৪ জন। 

এছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের শিবির ট্যাগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ১ জন সমন্বয়ক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেমঘটিত কারণে ভুল বোঝাবুঝির জের ধরে আরেকজন সমন্বয়কের ওপর হামলা করা হয়েছে।

শেষ ঘটনাটি মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ। জাতীয় দৈনিক কালবেলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সচিব ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ওমর ফারুক সাগরের ওপর হামলা চালায় ছাত্রশিবিরের সদস্যরা। 

এই ৩৬টি ঘটনায় কমপক্ষে ৮৯ জন আহত হয়েছেন। মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িকেন্দ্রিক সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায়। এই ঘটনায় ১৭ জন আহত হলেও চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবুল কাসেম (২০) নামের এক যুবক মারা যান।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence