নাতিকে আইসক্রিম কিনে দিতে গিয়ে শহীদ হন মায়া ইসলাম
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৪:২৬ PM , আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৫, ০৪:২৯ PM

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, শুক্রবার। বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় নাতি বাসিত খান মুসাকে (৭) আইসক্রিম কিনে দিতে ছয়তলার বাসা থেকে নিচে নেমেছিলেন মায়া ইসলাম (৫২)। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
বাসার মূল গেট বন্ধ থাকায় গেটের ভেতরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দাদি-নাতি। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ছোড়া পুলিশের একটি গুলি মুসার মাথায় বিদ্ধ হয়ে পেছনে থাকা মায়া ইসলামের তলপেটে ঢুকে যায়। মুসা গুরুতর আহত হলেও বেঁচে যায়, কিন্তু প্রাণ হারান মায়া ইসলাম।
সেদিন রাজধানীর রামপুরা থানার সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। একসময় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত মনে হলে নাতির আবদার রাখতেই মায়া ইসলাম বাসার নিচে নামেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওই গুলি এসে নাতি মুসাকে আহত করে এবং দাদি মায়ার প্রাণ কেড়ে নেয়।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম।
মায়া ইসলামের স্বামী মাহবুব ইসলাম মালিবাগ বাজারে একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের দোকান চালান। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান মুসাকে নিয়ে রাজধানীর রামপুরার মেরাদিয়া হাট এলাকায় ছয়তলার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানেই থাকতেন মায়া ইসলাম ও তার স্বামীও।
ঘটনার দিন মুসা তার মা নিশামনিকে বলেছিল, “মাম্মি, বাইরে গুলির শব্দ হচ্ছে।” মা বাইরে যেতে নিষেধ করলেও আইসক্রিমের বায়না থামেনি। পরিস্থিতি একটু শান্ত মনে হলে দাদি নাতিকে নিয়ে নিচে নামেন। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘটে যায় ট্র্যাজেডি।
মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, গুলি লাগার পরপরই ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। প্রথমে মুসাকে নেওয়া হয় বনশ্রী এলাকার একটি হাসপাতালে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অন্যদিকে, মায়া ইসলামকে বনশ্রী হাসপাতালে নেওয়া হলেও অবস্থার অবনতি হলে ২০ জুলাই সকালে ঢাকা মেডিকেল নেওয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
গুলিবিদ্ধ মুসাকে শুরুতে ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউতে রাখা হয়। অবস্থার উন্নতি হলে সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হয়, কিন্তু ফের জটিলতা দেখা দিলে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সহায়তায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ২২ অক্টোবর মুসাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়, যেখানে সে এখনও চিকিৎসাধীন।
মুসার দাদা মাহবুব ইসলাম বলেন, “আমার স্ত্রীকে হারিয়েছি। কিন্তু নাতিকে বাঁচানোর লড়াই করছি। চিকিৎসা চলছে, তবে সে পুরোপুরি সুস্থ হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নই। এই শিশু এক বুলেটের আঘাতে তার দাদিকে হারিয়েছে, নিজেও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে।”
শহীদ মায়া ইসলামের পরিবার এই হত্যার বিচার চায়। মাহবুব ইসলাম বলেন, “আমার স্ত্রী ও নাতির ওপর যে জুলুম হলো, তার বিচার চাই। এ ঘটনার পর আমাদের সংসার এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার ছেলে ও পুত্রবধূ সারাক্ষণ হাসপাতালে, আমি একা হয়ে গেছি। আমরা ভালো নেই।”
এই হত্যার ঘটনায় মায়া ইসলামের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ১ নভেম্বর খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৮৭ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার মধ্যে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও রয়েছেন।
বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না, তা অনিশ্চিত মুসার জন্য তার পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রার্থনা করছেন। মাহবুব ইসলাম বলেন, “মুসা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে ছোট যোদ্ধা। এক বুলেটে তার দাদি শহীদ হয়েছেন, আর মুসা আহত হয়েছে। এখনো সে বেঁচে থাকাটা যেন এক অলৌকিক ঘটনা।”
সূত্র: বাসস