বিধিবহির্ভূতভাবে বাহিনীর পাইলটদের বাণিজ্যিক ফ্লাইটে সুযোগ দিতে নানা কৌশল বিমানের

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স  © লোগো

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী দেশের একমাত্র উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তার বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য বিমান বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের নিয়োগের জন্য নানা অনিয়মের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বিমানের একটি সভায় বাহিনীর প্রাক্তনদের বিধিবহির্ভূতভাবে ৪০ বছর বয়সে বিমানে প্রবেশের সিদ্ধান্ত হলেও এটি আরও ১০ বছর বাড়িয়ে ৫০ বছর করার চেষ্টা করেছে সংস্থাটির একটি পক্ষ। সেজন্য সভায় উপস্থিত না থাকলেও বিমানের নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন—এমন তথ্য উল্লেখ করে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এর বিরোধিতা করেছেন বিমানের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সংস্থাটির এ সংক্রান্ত দুটি সভার কার্যবিবরণী সংক্রান্ত নথি থেকে বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগে বিমানের এমন উদ্যোগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিগত ২৫ ফেব্রুয়ারির সভায় বিমানের শীর্ষ নির্বাহীরা থাকলেও বিগত মার্চের ১৭ তারিখে (জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস) অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন না তারা। পরবর্তীতে বিমানের ডিরেক্টর (ফ্লাইট অপারেশনস) ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠি দিয়ে নতুন এ সিদ্ধান্ত থেকে বের হওয়ার অনুরোধ জানান। নতুন এ নীতিমালা পাস করতে বিমানের শীর্ষ নির্বাহীদের বাদ দিয়ে বৈঠক করা হয়েছে বিগত ১৭ মার্চ তথা সরকারি ছুটির দিনে।

বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য পাইলট নিয়োগে বয়স ৫০ করার কোন প্রস্তাব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নেইশফিউল আজিম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

বিমানের সর্বশেষ চিঠিতে জানানো হয়েছে, ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় পরিচালক ফ্লাইট অপারেশনস, সহ-ফ্লাইট অপারেশন এক্সিকিউটিভের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। যদিও সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তারা ওই সভায় ছিলেন না একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এছাড়াও বিমান বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী থেকে আসা পাইলটদের যুদ্ধবিমান পরিচালনার প্রশিক্ষণ থাকলেও তাদের বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা থাকে না। এমন সিদ্ধান্ত ভালো ফলাফল দেবে না বলেও অভিমত সংশ্লিষ্টদের। 

বিমানে ক্যাডেট পাইলটদের নিয়োগে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩৫ বছর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল; যা বিমানের বর্তমান নিয়োগের সাথে সাংঘর্ষিক। এখন বিমানে নিয়োগে ৩০ বছর বয়সসীমা এবং ১৫০ ঘণ্টা ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। 

আরও পড়ুন: এমডির কক্ষ থেকেই বিমানের প্রশ্নফাঁস, ফোনে ছবি তুলে সরবরাহ

বিমানের নিয়োগ সংক্রান্ত সাব-কমিটি উপস্থিত বিমান পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড সদস্যদের অনুরোধে বিগত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ বয়সসীমা ৪০ বছর করতে সম্মত হলেও পরবর্তীতে এটি ৪০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৫০ বছর করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তীতে সভা শেষে একটি খসড়া প্রস্তাবে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন এক্সিকিউটিভদের সম্মতি ছাড়াই প্রাক্তন পরিষেবাধারীদের (বিমানবাহিনী বা অন্য কোনো সংস্থা) জন্য ৫০ বছর বয়সে পরিবর্তন করা হয়েছিল।

এছাড়াও একই সভায় প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩০ বছরের পর অতিরিক্ত ১ বছরের জন্য ২০০ ঘণ্টা করে ওড়ার অভিজ্ঞতা থাকলে তাকে চাকুরিতে প্রবেশের সুযোগ দানের বিষয়েও। তবে বিমানের নির্বাহীদের না রেখে ছুটির দিনে ১৭ মার্চ সম্পন্ন ওই সভায় ২০০ ঘণ্টার এ বাধ্যবাধকতাকে পাশ কাটিয়ে মোট ১ হাজার ঘণ্টা রাখা হয়েছে। যাতে ওএমডি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল লঙ্ঘন বলেও জানানো হয়েছে একই চিঠিতে।

বিমানের বহরে বর্তমানে রয়েছে অত্যাধুনিক অনেক উড়োজাহাজও। ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ রাখার বাধ্যবাধকতার বিষয়ে উল্লেখ করে বিমানের একই চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে, যেন এটি সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত রাখা হয়, কোনোভাবেই এটি যেন ৫০ বছর না হয়। বিগত ফেব্রুয়ারিতে গৃহীত ৪০ বছর বয়সে বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার জন্য। এছাড়াও ৫০ বছর বয়সে কেউ বিমানে প্রবেশ করলে তিনি ১০ বছর সেবা প্রদান করতে পারবেন—যা এয়ারলাইনের জন্য ক্ষতিকর হবে বলেও জানানো হয়েছে একই চিঠিতে।

বর্তমানে দেশের বেসামরিক খাতের বিমান চলাচল এবং সংশ্লিষ্ট পেশাগত স্বীকৃতি প্রদান করে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি)। বর্তমানে সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট কোর্স সম্পন্ন করে পেশাদার বৈমানিক হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে থাকেন প্রার্থীরা। একই সাথে থাকতে হয় নির্দিষ্ট সময় ও শ্রেণির উড়োজাহাজ পরিচালনার বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতাও।

আরও পড়ুন: পরিকল্পিতভাবেই বিমানের প্রশ্ন ফাঁস

বর্তমানে বিমানের বহরে থাকা অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৩৭ এবং ড্যাশ৮-৪০০ পরিচালনার জন্য নিয়োগ পান ফ্রেশ এবং টাইপ রেটেড ক্যাডেট পাইলটরা। এর মধ্যে নির্দিষ্ট ধরনের উড়োজাহাজ পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হয় ৫শ’ ঘণ্টার। টাইপ রেটেড পাইলট ছাড়াও একই সমান শর্তে বিমানে নিয়োগে হয় পাইলটদের। তবে এক্ষেত্রে প্রার্থীর জেট অভিজ্ঞতা অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে সংস্থাটিতে।

এর আগে বিমান বাহিনী এবং অন্য বাহিনী থেকে আসা পাইলটদের বিশেষ সুবিধাদানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বেসামরিক ও সাধারণ প্রার্থীরা বলছেন, নিজেদের আত্মীয় এবং পরিচিতজনদের নিয়োগ দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বিমান। এর আগেও তারা এমন চেষ্টা করেছে, কিন্তু তা নানামুখী বাঁধার কারণে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তাদের মতে, এমন বৈষম্যমূলক নীতি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত না। বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য নিয়োগ হওয়া উচিত সমান প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে।

যদি সত্যিকার অর্থেই বিমান বাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনী থেকে বয়সসীমা শিথিল করে নিয়োগ প্রদান করা হয় তাহলে এটি আমাদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং হবে এবং বিমানে নিয়োগ পাওয়া আমাদের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধই হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছেবাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য পেশাদার লাইসেন্সধারী (সিপিএল) প্রার্থীরা।

বিগত বছরের শেষদিকে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এ উড়োজাহাজ সংস্থার পাইলট নিয়োগে গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি। আদালতের নির্দেশনা মেনে ওই প্রতিবেদন জমা দেয় বেসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদন জমা দেয় চলতি মাসের প্রথমভাগে। তদন্তে উঠে এসেছে, নিয়োগকৃত ১৪ জন পাইলটের মধ্যে ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন মাত্র পাঁচজন। বাকিরা জাল সনদ, অযোগ্যতা ও লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে আটকে আছেন। অথচ বিমান তাদের পেছনে মোটা অঙ্কের বেতন ও প্রশিক্ষণের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে বলেও জানানো হয়েছে একই তদন্ত প্রতিবেদনে।

আমি বিগত পাঁচ বছর ধরে বিমানের কলের জন্য অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে বিমান বিগত ২০১৮ সালে সর্বশেষ নিয়োগ দিয়েছিল। এখন যে বিষয়টি আসছে—যদি সত্যিকার অর্থেই বিমান বাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনী থেকে বয়সসীমা শিথিল করে নিয়োগ প্রদান করা হয় তাহলে এটি আমাদের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং হবে এবং বিমানে নিয়োগ পাওয়া আমাদের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধই হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে—বলছিলেন একজন বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার জন্য পেশাদার লাইসেন্সধারী (সিপিএল) কয়েকজন প্রার্থী। তবে তারা নাম এবং পরিচয় গোপন রাখতে অনুরোধ জানিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। তবে বিমানে নবীন পাইলট হিসেবে প্রবেশের বয়সসীমা মুক্তিযোদ্ধা কোটার সমান ৩২ বছর রাখার দাবিও এই তরুণদের।

আরও পড়ুন: প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বিমানের ২৬ কর্মচারীসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) শফিউল আজিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য পাইলট নিয়োগে বয়স ৫০ করার কোন প্রস্তাব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নেই। তবে ৪০ বছর করার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো কিছু জানাননি রাষ্ট্রীয় আকাশযান সংস্থার এ শীর্ষ নির্বাহী।

 

সর্বশেষ সংবাদ