মেলায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনার

স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা
স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা  © টিডিসি ফটো

অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় শত শত বইয়ের স্টলে লাখ লাখ বইয়ের সমাহার থাকলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী বই পাওয়া দুষ্কর। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অনেকেই হয়তো মেলায় আসে এবং ঘুরে ফিরে চলে যায়। তারা তাদের সুবিধা অনুযায়ী কোন বই পড়া বা কেনার সুযোগ পায় না।

কারণ তাদের ব্রেইল বই পড়েই জ্ঞান অর্জন করতে হয়। তাদের অনেকেই হয়তো জানেও না যে কোনো স্টল বা বইয়ের দোকানে এ ব্রেইল বই কেনা বা পড়ার সুযোগ আছে কিনা।

এসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন বই পড়ার চাহিদা মেটাতে 'স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা' নামে স্পর্শ ফাউন্ডেশনের একটি স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক একটি প্রকাশনা প্রতিবছরের ন্যায় এবারের মেলায়ও স্টল করেছে।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের সামনে অথবা বাংলা একাডেমির ২ নাম্বার গেইট সংলগ্ন 'স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা' নামে ৭৬৭-৭৬৮ নং স্টল।

এখানে পড়তে সক্ষম যেকোনো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বই পড়তে পারেন এবং রেজিস্ট্রেশন করে নির্দিষ্ট সময় পর বিনামূল্যে ব্রেইল বই পেতেও পারেন। উক্ত প্রতিষ্ঠান এবার মেলায় একশত ব্রেইল বই নিয়ে হাজির হয়েছে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে করছে স্বেচ্ছাসেবী এ প্রকাশনাটি।

এ স্টলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী যারা আসেন তাদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, খুব আনন্দ ও আগ্রহের সাথে বই পড়তে দেখা যায়। এমনি একজন পাঠক হলেন আনিকা ইবনাত নামীরা। তিনি রাজধানীর এক স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, 'স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা'র প্রতি অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা আমাদের বই পড়ার জন্য এত সুন্দর একটা পরিবেশ করে দেয়ার জন্য। আমি এখানে আসতে পেরে খুব খুশি। আমি এখন স্পর্শছুড়ি নামের গল্পের বই পড়ছি। এতে আমার খুব ভাল লাগছে।"

আসিফ করিম পাটোয়ারী নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বলেন, 'স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা'র শুরু থেকেই আমি এখানে আসি। যখন এই ব্রেইল প্রকাশনা ছিল না তখনও আমি মেলায় আসতাম। তখন বিভিন্ন দোকানে গিয়ে বইগুলো শুধু উল্টাপাল্টা করতাম এবং শুধুই নতুন বইয়ের গন্ধ পেতাম, কিন্তু পড়তে পারতাম না। আর যখনই এই স্টলটা তৈরি হলো এবং আমাদের পড়ার মত বই হলো, তখন আমাদের আনন্দ দেখে কে! তখন খুশি হয়েছি আমরা।'

তিনি আরো বলেন, "আমরা বই পড়তে চাই। আমাদের পড়ার আগ্রহ আছে অনেক, কিন্তু সুযোগ নেই। আমরা এই সুযোগটা চাই। স্পর্শ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা যিনি আছেন নাজিয়া জাবীন আন্টি, আমরা ওনাকে এখানে আরো এরকম বই সংযুক্ত করার জন্য বলি। এছাড়াও এই অমর একুশে বইমেলায় অংশ নেয়া প্রতিটি প্রকাশনায় যেন আমাদের জন্য প্রতিবছর একটি করে হলেও ব্রেইল বই রাখা হয়। স্পর্শ প্রকাশনার মত মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান আর নাজিয়া আন্টির মত মাত্র একজন মানুষের দ্বারা তো আসলে সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ কাজটি এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাই।'

শেখ আরাফাতুল হোসেন নামে তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী বলেন, 'আমি এখানে এসে 'রসগোল্লাটা কথা বলে' বইটা পড়ছি, খুব ভাল লাগছে আমার। এই বইয়ের লেখক হলেন, লুৎফর রহমান রিটন।"

'স্পর্শ ফাউন্ডেশন' ও 'স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা'র প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি নাজিয়া জাবীন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, "আমি মূলত শিশুতোষ লেখক এবং বাচ্চাদের জন্য বই লিখি। শিশুদের নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল বইমেলায়। তখন বইটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরা হাতে নিয়ে পড়তে পারেনি। এ ব্যাপারটি আমার কাছে অনেক খারাপ লেগেছিল। অন্যান্য বাচ্চারা পড়তে পারবে কিন্তু এই বাচ্চারা পড়তে পারবে না, বইয়ের মধ্যে এরকম পার্থক্য কেন থাকবে? এজন্য ২০০৯ সালে আমার লেখা একটি ব্রেইল বই প্রকাশ করি। ২০১০ সালে আবার আরেকটি ব্রেইল বই প্রকাশ করা হয়। ২০১১ সালে এসে আমার মনে হল যে, ওরা শুধু আমার বই কেন পড়বে? ওরা সারা পৃথিবীর বই পড়বে। ওদের জন্য সারা পৃথিবীর বইয়ের দুয়ার খুলে দিতে হবে। ওরা পড়তে চায়। ওদের জানার আগ্রহ আছে। ওরা আপনার আমার মতো করে গরগর করে বই পড়তে পারে। বই পড়া ও জ্ঞান অর্জনের অধিকার তো সকলেরই সমান। সেই হিসেবে তাহলে ওদের কেন অধিকার আমরা দিব না? এ চিন্তাকে মাথায় রেখেই আমরা(স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা) বাংলা একাডেমিতে যুক্ত হলাম। যাতে মানুষ এ ব্যাপারে জানে। মানুষ যত বেশি জানবে তত বেশি এদের পাশে দাঁড়াবে। এভাবে ২০১১ সাল থেকে শুরু করে আমরা প্রতি বছরই মেলায় অংশগ্রহণ করি।"

তিনি আরো বলেন, "যে বইটা বেশি এক্সপেন্সিভ সেই বইটা আমরা অনেক বেশি তৈরি করতে পারিনা। প্রতিবছর তিন/চারটা করে আমরা বই বের করি এবং বইগুলো ওদের হাতে তুলে দেই। আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং আমার পরিচিত যারা আছেন তাদের অনেকেই এই কাজে এগিয়ে এসেছে। এভাবেই আমরা কাজ করছি এবং ধাপে ধাপে আগাচ্ছি। এ বছর আমাদের প্রকাশিত ব্রেইল বইয়ের সংখ্যা একশোতে দাড়িয়েছে। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে ১০০ টি বই প্রকাশকে আমরা মাইলফলক হিসেবে দেখছি।"

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এ কাজ অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং বই প্রকাশকরা সহ সর্বস্তরের মানুষকে এরকম মানবিক কাজে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ