একুশের টান দুঃসাহসী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ: প্রধান উপদেষ্টা
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ PM , আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০৬ PM

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, একুশের টান বয়সের ঊর্ধ্বে। প্রজন্মের ঊর্ধ্বে। একুশের টান প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিস্তৃত হয়েছে শুধু তাই নয়, এই-টান গভীরতর হয়েছে। আমাদেরকে দুঃসাহসী করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশকে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে। আমাদের রাস্তার দেয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এগুলোর স্থান এখন একন আমাদের বুকের মধ্যে, জাদুঘরে হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
আজ শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বাংলা একাডেমিতে মাসব্যাপী অমর একুশের বইমেলার উদ্বোধন শেষে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের আকা ছবিগুলো যারা মেলায় স্থান করে দিয়েছে। সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। বইমেলার একাংশে এই তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনী করা গেলে বইমেলায় আসা ক্রেতারা, দর্শকরা উপকৃত হত।
তিনি বলেন, আমি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জুলাইয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে যেসব দুঃসাহসী ছাত্র-জনতা-শ্রমিক প্রাণ দিয়েছেন এবং নির্মমভাবে আহত হয়েছেন তাদের সবাইকে। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং তার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ।
ড. ইউনূস বলেন, বরাবরই একুশে মানে জেগে ওঠা। একুশে মানে আত্মপরিচয়ের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া। একুশে মানে অবিরাম সংগ্রাম। নিজের পরিধিকে আরো অনেক বাড়িয়ে নেওয়া। এবারের একুশের পরিপ্রেক্ষিত আমাদেরকে নতুন দিগন্তে প্রতিস্থাপন করেছে।
বরকত, সালাম, রফিক, জাব্বারের বুকের রক্তে যে অঙ্গীকার মাখা ছিল তাতে ছিল জুলাই অভ্যুত্থানকে নিশ্চিত করার মহা বিস্ফোরক শক্তি। অর্ধশতাব্দী পর এই মহাবিস্ফোরণ গণঅভ্যুত্থান হয়ে দেশ পাল্টে দিল। এই বিস্ফোরণ আমাদের মধ্যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় গ্রোথিত করে দিয়ে গেল। অমর একুশের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা এই প্রত্যয়ে শপথ নিতে এসেছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়। একুশ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। এই বন্ধন ছোট-বড়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ক্ষণস্থায়ী- দীর্ঘস্থায়ী সব দূরত্বের ঊর্ধ্বে। এজন্য সব ধরনের জাতীয় উৎসবে, সংকটে, দুর্যোগে আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। সেখানে আমরা শান্তি পাই। স্বস্তি পাই। সমাধান পাই। সাময়িকভাবে অদৃশ্য ঐক্যকে আবার খুঁজে পায়। ২১ আমাদের মানসকে এভাবে তৈরি করে দিয়েছে। একুশ আমাদের পথ দেখায়। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এক দেশকে দ্রুততম গতিতে আবার উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহস খুঁজে পেয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির ঘাড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চেপে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। আমাদের সাহসী তরুণদের এই অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে এসেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা। যাদের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত অভ্যুত্থান এবারের বইমেলা নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। বইমেলায় হাজির করার জন্য লেখক লেখিকারা সারা বছর প্রস্তুতি নিতে থাকেন যথাসময়ে নিজ নিজ বই সমাপ্ত করার জন্য। প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য। গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিষয় ভিত্তিক সেরা লেখক স্বীকৃতির আয়োজন করলে লেখকরা এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এবং সেরা লেখকরা সেরা প্রকাশক পাওয়ার ব্যাপারে সহায়ক হতো। আমি এ প্রস্তাব দিচ্ছি।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা যদি একুশের ভাষা আন্দোলনকে আরো গভীরতর প্রেক্ষিতে স্বাধিকার আন্দোলন হিসাবেও দেখি তাহলে অমর একুশের গণ্ডি বৃহত্তর হয়ে দাঁড়ায়। তখন আমরা ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের তাদের সৃজনশীলতার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি, নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। শহর ও গ্রামের নারী পুরুষকে কৃষি, শিল্প, সাংস্কৃতিক জগৎ, বিজ্ঞান, বাণিজ্য শিক্ষায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যারা নির্দিষ্ট বছরে জাতির জন্য অবদান রেখেছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে পারি, তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে দিতে পারি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের, প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি দিতে পারি। সারা পৃথিবী জুড়ে নানা কাজে বাংলাদেশিরা কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। আমরা একুশের দিনে তাদের সবাইকে স্মরণ করতে চাই। তারা সবাই একুশের দিনে নিজের দেশকে স্মরণ করে অনুষ্ঠান করে। তারা আমাদের পরিবারের অংশ হিসেবে তাদের সন্তান-সন্ততির কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়।
আমার সব কথা আপনাদের গ্রহণ করতে হবে এমন চিন্তা করি না। তবে নিজের বলার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন বলে রাখলাম, বলেন উপদেষ্টা।
বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।