‘দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ’— পাঠ্যবই থেকে শিখবে শিক্ষার্থীরা
- আহমেদ ইউসুফ
- প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:১৫ PM , আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১৬ PM
২০২৫ সালে বছরের নয় দিন পার হলেও অল্পকিছু ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের এক বক্তব্য থেকে জানা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা কবে নাগাদ সব নতুন পাঠ্যবই হাতে পাবে, তা তিনিও জানেন না।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত সেপ্টেম্বর থেকে নতুন পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ শুরু করে এ পর্যন্ত একের পর এক বিতর্কের মুখে পড়েছে এনসিটিবি। জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার ছবি পাঠ্যবইয়ের পেছনে যাওয়া, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাইদের মৃত্যু তারিখ ভুল ও এনসিটিবির হ-য-ব-র-ল অবস্থাসহ বেশ কয়েকবার সমালোচনার মুখে পড়েছে এনসিটিবি।
নবম-দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই
তবে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে এবার নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চব্বিশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নৃশংসতা ও বর্বরতা চালানো দল আওয়ামী লীগকে দেশের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। এনসিটিবি কর্তৃক মুদ্রিত মাদ্রাসা বোর্ডের ও মাধ্যমিক স্তরের নবম-দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে পতিত আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রচারিত নবম-দশম শ্রেণীর ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বই বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বইটির ৭৩ নং পৃষ্ঠায় ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ টপিকের ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সাব টপিকে বলা আছে, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।’
বইটির একই অধ্যায়ে বিএনপি সম্পর্কেও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সাবেক সেনাপ্রধান উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে সামরিক শাসনামল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বইটির ৭৩ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। এ দলটি ইসলামী মূল্যবোধ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী।’
তবে আওয়ামী লীগকে নিয়ে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কোনো তথ্য না এনে উলটো বড় দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি সহ রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক সদস্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কয়েক মাস আগে যে দলটি হাজার হাজার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, হাজার হাজার ছাত্র জনতা এখনো হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে। আহতরা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে জীবনের স্বপ্ন বিলীন করেছেন। গণ অভ্যুত্থানের এসব স্মৃতি মুছে না যেতেই স্বৈরাচারী দলটিকে নিয়ে পাঠ্যবইয়ে এ ধরনের তথ্য উপস্থাপন ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত বহন করে।
তারা আরো বলেন, দল যদি বৃহৎ হয় তাহলে দলের প্রধান কেন দেশ ছেড়ে ভারতে পালাল? এটা কি অবান্তর ও বানানো গল্প নয়? যে গল্প সুপরিকল্পিত ভাবে ফ্যাসিবাদকে ফিরিয়ে আনার পক্ষে সাফাই। কিন্তু প্রশ্ন হল, যারা পরিমার্জন করেছে তারা কোন আশায় বিষয়টি এরূপ রাখল? পরিমার্জনের পর সম্পাদনায়ও এই তথ্য কেন দেখা হয়নি। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে এই তথ্য ইচ্ছাকৃত রাখা হয়েছে।
‘বিষয়টি নিয়ে আমরা পরিমার্জন কমিটির সাথে কথা বলছি। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিষয়ে চব্বিশের বর্বরতা কেন যুক্ত হল না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ইতিহাস বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল একাত্তর পর্যন্ত যুক্ত করার বিষয়ে। চব্বিশের ইতিহাস পরে যুক্ত করা হবে‘। —চেয়ারম্যান, এনসিটিবি
এসব বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক অভিভাবক। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট কামাল হোসেন জানান, একজন সচেতন অভিভাবক ও আইনজীবী হিসেবে বলছি, এনসিটিবির এ ধরনের কাজ আমাদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। একটি দলের এত পরিমাণ বর্বরতার পরেও সেসব না লিখে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে বৃহৎ দল হিসেবে পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করাটা ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। বিষয়গুলো সরকারের নজরে থাকা উচিত।
এসব বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা পরিমার্জন কমিটির সাথে কথা বলছি। বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিষয়ে চব্বিশের বর্বরতা কেন যুক্ত হল না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ইতিহাস বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল একাত্তর পর্যন্ত যুক্ত করার বিষয়ে। চব্বিশের ইতিহাস পরে যুক্ত করা হবে।