রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষাঙ্গনেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শতাধিক শিশু

শিক্ষাঙ্গনেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শতাধিক শিশু
শিক্ষাঙ্গনেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শতাধিক শিশু  © টিডিসি ফটো

চায়ের কাপ-সিগারেট কিংবা যেকোনো খাবার হাতে ক্রেতাদের নিকট ছুটোছুটি। সুযোগ পেলেই একটু-আধটু খুনসুটি এবং পুনরায় কাজের ব্যস্ততা—এভাবেই শেষ হয় তাদের দিন। অনেক সময় খেয়ে/না খেয়েই হয় রাত। অথচ সদা হাস্যজ্জল মুখে শত মানুষের ক্ষুধা নিবারণে কাজ করছে শতাধিক শিশু।

শৈশবের আনন্দ ভুলে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এসব শিশুরা দিনভর পরিশ্রম শেষে কেউ হোটেল কেউ ক্যান্টিনের মেঝেতে অথবা দোকানের ব্যঞ্চেই ঘুমিয়ে পড়ছে। আবার কেউ গভীর রাতে নামমাত্র মজুরি হাতে ফিরছে নিজ ঘরে।

চিত্রটি দেশের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। যেখানে হাজারো আলোকিত মানুষের সংস্পর্শে থেকেও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শতাধিক শিশু। এমনকি অভাব-অনটনের ভাঁড়ে চাপা পড়ছে তাদের শৈশবের আনন্দটুকুও। ফলে স্বপ্ন পূরণের জায়গায় স্বপ্ন দেখারই সাহস হারিয়ে ফেলছে এই কোমলমতি শিশু-শ্রমিকেরা।

ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্বিবদ্যালয়ে অবস্থিত বিভিন্ন হোটেল-ক্যান্টিন কিংবা অন্যান্য ছোট-বড় দোকানে শতাধিক শিশু কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৫ বছরের কম। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে গিয়ে নূন্যতম শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে তারা। অপরদিকে অনেকে পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য শ্রমের মজুরি। এমনকি কাজ করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে চা-কাপ ও সিগারেট নিয়ে ছুটোছুটি করছে এক অল্প বয়সী শিশু। অতি অল্পসময়ের মধ্যেই চমৎকারভাবে সকলের সাথে মেশার গুণ রয়েছে তার। ক্রেতার এক-কাপ চা শেষ করার আগেই সখ্যতা গড়ে তুলছে এ শিশু। কথা বলে জানা গেল, চা-দোকানদার এনামুল হকের দোকানে কাজ করে ১৪ বছর বয়সী জুলফিকার। অভাবের তাড়নায় নাটোর থেকে ছুটে এসেছে রাবিতে।

জুলফিকার জানায়, তার বাড়িতে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কেউ নেই। বাবা নেশা করে। ভাই-বোন ছোট। বাধ্য হয়েই সে এখানে কাজ করতে এসেছে। সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানে কাজ করে মাসে মাত্র চার হাজার টাকা পায় জুলফিকার। মাঝেমধ্যেই বাড়িতে টাকা না পাঠালে বাড়িতে অত্যাচার করে নেশাখোর পিতা।

জুলফিকার জানিয়েছে, সুযোগ পেলে পড়াশোনার ইচ্ছে রয়েছে তার। সে গ্রামে থাকাকালীন সময়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। সেই সময়টা অনেক সুন্দর ছিল বলে জানিয়েছে সে।

ক্যাম্পাসের ব্যবসায়ী বাবুর হোটেলে দেখা মেলে আরেক শিশু-শ্রমিক ইব্রাহিমের সাথে। জানা গেল রাজশাহীর চারঘাট থেকে জীবিকার তাগিদে এসেছেন ১০ বছর বয়সী এ শিশু। বাবা মারা গেছে। তাই কাজ করার জন্য হোটেলে এসেছে ইব্রাহিম। দিনে একশো টাকার বিনিময়ে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাকে।

ইব্রাহিম জানায়, সে হোটেলে খেয়ে রাতে সেখানে থাকা ব্যঞ্চের উপরই ঘুমায়। সেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু করোনার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাবা মারা গেলে স্কুল ছেড়ে এ হোটেলের টেবিল-চেয়ারের সাথে বসবাস শুরু করে সে।

একই দোকানে কাজ করে ১২ বছর বয়সী তরিকুল ইসলাম। সে দেড়শো টাকা বেতনে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুরের মিজানের মোড়ে তার বাড়ি। উপার্জিত এ টাকা দিয়ে নিজে চলার পাশাপাশি সান্ধ্যকালীন এক স্কুলে পড়াশোনা করে তরিকুল। তার স্বপ্ন পড়াশোনা শিখে ইনঞ্জিনিয়ার হওয়া। 

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজারের চায়ের দোকানে কাজ করেন ১০ বছর বয়সী ওমর। সন্ধ্যা ৫-৬ ঘণ্টা কাজের বিনিময়ে পায় মাত্র ৫০ টাকা। ওমর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক মেকানিকের দোকানে সপ্তাহে মাত্র চারশো টাকার বিনিময়ে কাজ করে। 

এছাড়া ক্যাম্পাসে বিভিন্ন দোকানে কর্মরত শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিবারে অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্রতা ও শিক্ষাগ্রহণের সামর্থ্য না থাকার কারণেই পড়াশোনা ছেড়ে দোকানে কাজ করছে তারা। তবে একটু সুযোগ পেলে পড়াশোনারও আগ্রহ রয়েছে তাদের। কিন্তু এতে যেটুকু উপার্জন হচ্ছে, সেটাই উপকার বলে মনে করছে এদের পরিবার।

তাছাড়া তাদের অনেকের পিতা-মাতা না থাকায় বাধ্য হয়েই শ্রম বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে অনেক সময় সারাদিন কাজ করতে গিয়ে একটু বেখেয়ালি হলেই বকুনি খেতে হয় মালিকের। এমনকি কাজে একটু কম পারদর্শী হলে অনেকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথাও জানান।

জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে (২০০৬) ১৪ বছরের কম বয়সী কাউকে শ্রমিকের কাজ ব্যবহার না কারার নির্দেশ দেয়া আছে। 
এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসারে, যখন কোন শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে; তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে।

আরও পড়ুন: ৭৫ শতাংশ শিশু পর্নোগ্রাফি দেখে

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে শিশুশ্রমকে অপরাধ চিহ্নিত করে এ কাজকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে এসব আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোথাও। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক জায়গায় শিশুদের নামমাত্র মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবুঝ, অল্পেতুষ্ট ও বাধ্য হয়ে কাজে আসার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক সময় শিশুদের খাটিয়ে নিচ্ছে মুনাফালোভীরা। তবে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে দেশে দৃশ্যমান তেমন কোন শাস্তিও দেখা যায় না।

শিশু-শ্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে দোকান-মালিকরা বলছেন, অনেকের যাওয়ার কোন জায়গা নেই। তাই তারা এখানেই খায়-এখানেই ঘুমায়। এখানে যেটুকু টাকা পায়, সেটা দিয়ে তাদের পরিবার কিছুটা উপকৃত হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের উদ্যোগে পড়াশোনা করানোর সামর্থ্য নেই। তারা কাজ করে সেরকম টাকাও পাচ্ছে না।

হোটেল ব্যবসায়ী বাবু বলেন, এই হোটেলে যারা কাজ করে, তাদের অধিকাংশ অনাথ। কারো বাবা নেই, পরিবারে কারো উপার্জন করার মতো কোন ব্যক্তি নেই। তাই এখানেই খেয়ে-পরে দিন পার করে। কেউ যদি তাদের পড়াশোনা করাতে আগ্রহী হয়, তবে তিনি দিনে তাদের ২/৩ ঘণ্টা পড়াশোনা করার সুযোগ দেবেন।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ করা হয়। এমনকি বিনামূল্যে এ শিক্ষা গ্রহণের পাশপাশি বৃত্তিমূলক ব্যবস্থাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকারের এত উদ্যোগ স্বত্বেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত এমন কাজ চলছে। অথচ এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট কারোই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই শিশুশ্রমের যথাযথ মূল্য না দেয়া এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েই এসব শিশুরা পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে কোন শিশু বঞ্চিত হওয়াও জাতির জন্য সুখবর নয়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় অবাধে শিশুশ্রম চালু থাকা এবং এ বিষয়ে প্রশাসনের কার্যকারী কোন ব্যবস্থা না থাকা খুবই দুঃখজনক। 

তারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে আলোকিত মানুষের চলাফেরা। এখানে মানুষ আসে জ্ঞানের আলো নিতে। পরবর্তীতে তাদের চিন্তা-চেতনা ও শিক্ষা-গবেষণার ফলেই জাতি নতুন কিছুর সন্ধান পায়। কিন্তু সেখানেই কেউ আলোকিত হবে, কেউ অন্ধকারে থাকবে সেটা কাম্য নয়। তাই জ্ঞান চর্চার আলোকবর্তিকা হিসেবে এসব শিশুকে শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সদস্য ও আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাদিকুল ইসলাম সাগর বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে যে শিশুশ্রমের চিত্রটি দেখা যায়, তা খুবই পীড়াদায়ক। কেননা এসব শিশুদের থেকে সারাদিন যে পরিমাণ কাজ করিয়ে নেয়া হয়, সেই তুলনায় পারিশ্রমিক তো দেয়া হয়ই না। অপরদিকে শিশুশ্রমের যে নীতিমালা রয়েছে, তা এখানে পুরোপুরিই লঙ্ঘিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, যেখানে প্রতিনিয়ত দক্ষ, সচেতন ও আলোকিত মানুষ তৈরি হচ্ছে- সেখানে এমন আইনের লঙ্ঘন খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, যারা সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। তাই প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এসব সংগঠনকে সহায়তা করার মাধ্যমে এই শিশুদের নূন্যতম প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করা সম্ভব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে দরিদ্র ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় থেকে কোন শিশু নূন্যতম শিক্ষা লাভের সুযোগ না পাওয়া দুঃখজনক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় অনাথ ও পথশিশুদের পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করা হয়। তবে দোকানপাটে কর্মরত এসব শিশুদের শিক্ষার উদ্যোগ নিলেও পরিবার ও সংশ্লিষ্ট দোকানদার/ মালিকের বাঁধায় তা পুরোপুরি সফল হয় না।

তারা জানান, পরিবার পড়াশোনা অর্থ জোগাড় করতে না পেরে কিছু উপার্জনের আশায় শিশুদের কাজে পাঠায়। অপরদিকে সেই সুযোগ কাজে লাগায় বিভিন্ন দোকান ব্যবসায়ীরা। তবে এসব শিশুর শিক্ষা গ্রহণে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মানবিকভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করলে এসব শিশুদের নিরক্ষরতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।

সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তার কথা জানতে চাইলে ছাত্র উপদেষ্টা তারেক নূর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাজ নিজেদের শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক কাজে সহযোগিতা করা। তাদের সার্বিক মান উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া। আবার ক্যাম্পাসের একটা অংশের সাথে জুড়ে আছে এসব শিশু। যারা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই ক্যাম্পাসের মধ্যেই তারা শিক্ষার আলো থেকে সরাজীবন বঞ্চিতই থাকুক, সেটাও কাম্য নয়।

তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে মানবিক দিক বিবেচনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এসব শিশুদের পাশে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এসব শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে অনেক শিশুই কাজ করে। তবে ক্যাম্পাসের অবৈধ দোকান উচ্ছ্বেদ ও বৈধদের সার্বিক তথ্য হালনাগাদ করণে কাজ চলছে। যদি বৈধ কোন দোকানে কর্মরত কোন শিশুকে বঞ্চিত করার প্রমাণ মেলে, তবে সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ