ডাকসুর গঠনতন্ত্র প্রস্তাবে বাদ পড়ছে যেসব বিষয়
- এম এইচ ইমরান
- প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৯ PM , আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫৩ PM

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এ দাবি জোরালো হয়েছে কয়েক গুণ। তবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে অতিদ্রুত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবির পরপরই শিক্ষার্থীরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের পরিমার্জনের।
এসব দাবির পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদদ্যের একটি সংস্কার কমিটি গঠন করে ঢাবি প্রশাসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা বিভিন্ন দাবি নিয়েই তৈরি করা হয়েছে নতুন এই খসড়া প্রস্তাব। গত ১৮ মার্চ এই খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফের মতামত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কাছে পাঠানো হয়।
নতুন প্রস্তাবে মোটাদাগে বাদ পড়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্য ও সমতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এ ছাড়া ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একক ক্ষমতায় কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে। সংসদের কোনো সদস্যকে বরখাস্ত, কার্যনির্বাহী কমিটি ভেঙে দেওয়া, নতুন নির্বাচনের আহ্বান একই সঙ্গে ছাত্র সংসদ স্থগিতের বিষয়ে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের কাছে উপাচার্যকে দ্বারস্ত হতে হবে।
গঠনতন্ত্রে যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব
গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ ‘ছাত্র সংসদের লক্ষ্যবস্তু’ অংশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে চব্বিশের জুলাই আন্দোলন। এ ছাড়া একই অনুচ্ছেদের ধারা ‘গ’-তে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ পরিমাণে একাডেমিক এবং অতিরিক্ত একাডেমিক সুবিধার বিষয়টি পরিবর্তন করে একাডেমিক এবং সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রমে শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর বিষয়টির প্রস্তাবনায় রাখা হয়েছে।
বর্তমান গঠনতন্ত্রে ৩(ক) অনুচ্ছেদের ডাকসুর কার্যক্রমে ছাত্র সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকার বিষয়টি নতুন করে প্রস্তাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। ডাকসুর কার্যক্রমে ৩(গ) অনুচ্ছেদে সময়ে সময়ে বিতর্ক, নাটক, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, সামাজিক সমাবেশের আয়োজন করার কথা থাকলেও নতুন প্রস্তাবনায় নাটক আয়োজনের অংশটি বাদ পড়েছে।
একই অনুচ্ছেদের ‘ছ’ ধারায় প্রতিবছর অন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথা উল্লেখ থাকলেও নতুন প্রস্তাবে ‘প্রতিবছর’-এর বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে বিতর্কের পাশাপাশি সম্মেলন এবং অনুরূপ অনুষ্ঠানের কথা প্রস্তাবিত করা হয়েছে।
সভাপতি হিসেবে উপাচার্যের ক্ষমতায় শিথিলতা
গঠনতন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে একক আধিপত্যের জায়গায় কিছু পরিবর্তন আসছে। বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৫(ক) অনুচ্ছেদে ছাত্র সংসদের পদাধিকারী এবং তাদের কার্যাবলিতে সব সভায় উপাচার্যের সভাপতিত্ব করার কথা থাকলেও নতুন প্রস্তাবে সব সভার বিষয়টা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সভাপতির আয়ত্তে থাকা ‘সমস্ত বিধির ব্যাখ্যা করা এবং তার ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত হওয়ার বিষটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একই অনুচ্ছেদের ‘ক’ ধারায় ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে উপাচার্য সংসদের সর্বোত্তম স্বার্থে যেকোনো সময়ে কার্যনির্বাহী কমিটির কোনো পদাধিকারী বা সদস্যকে বরখাস্ত করার, কার্যনির্বাহী কমিটিকে সামগ্রিকভাবে ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানানো বা ছাত্র সংসদ পরিচালনার জন্য তিনি উপযুক্ত মনে করেন, এমন অন্য পদক্ষেপ গ্রহণের নীতিমালা থাকলেও নতুন প্রস্তাবনায় তার অনেকটাই পরিবর্তন আসছে।
নতুন প্রস্তাবে সভাপতিকে কমিটির কোনো পদাধিকারী বা সদস্যকে বরখাস্ত, কমিটি ভেঙে দেওয়া, নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানানো বা অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে তাকে অবশ্যই সিন্ডিকেটের অনুমোদনের অপেক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে ছাত্র সংসদ স্থগিতের বিষয়টিও উপাচার্যের কাছে কিছুটা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বর্তমান সংবিধানের ৬(ক) অনুচ্ছেদে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে উপাচার্য নিজের ইচ্ছেমতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে কাউকে নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী ছাত্র সংসদের কার্যনির্বাহী কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করার বাধ্যবাধকতার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে সভাপতির কাছে নির্বাচন-সংক্রান্ত যেকোনো আপত্তি করা সভাপতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়টি অপরিবর্তত রাখা হয়েছে তবে। তবে ‘সভাপতির সিদ্ধন্তের বিরুদ্ধে আইনের কোনো আদালতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না’ সংগঠনের ৮(ধ) অনুচ্ছেদের এই নিয়ম বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এবং নিয়মটি হল সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রযোয্য হবে।
বাদ পড়েছে ও সংযোজন হয়েছে যা
গঠনতন্ত্রের ৫(ঙ) অনুচ্ছেদে ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক’ পদের নাম পরিবর্তন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক’ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব আন্দোলন-ঘটনার চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার উল্লেখ রয়েছে, সেখানে শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামটি থাকলে এর কিছুটা সংযোজন করে ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ করা হয়েছে। পাশাপাশি নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের কথা সংযুক্ত করা প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ছাড়া একই অনুচ্ছেদ থেকে মোটাদাগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্য ও সমতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে কমিটি।
ছাত্র সংগঠনগুলোর বক্তব্য
ডাকসুর গঠনতন্ত্র নিয়ে ১৮টি ও হল সংসদে ২২টি সংস্কার প্রস্তাবসহ মোট ৩৭৭টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে ছাত্রদল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সভাপতির ক্ষমতা কমিয়ে আনা এবং সভাপতি নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের সরাসরি হস্তক্ষেপ।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্র সংস্কারের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, সে বিষয়ে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত হইনি।
তিনি আরও বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা না হলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা নিতান্তই অনুচিত হবে বলে আমি মনে করি। তাই আপাতত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করছি না। আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত হলে আমরা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিক্রিয়া পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করব।
ডাকসু গঠনতন্ত্রে নতুন খসড়া প্রস্তাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি শাখা ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক মল্লিক ওয়াসী উদ্দিন তামিও একি কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এটি এখনো অফিশিয়ালি পাইনি। আমাদেরকে এখন পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। কেন জানানো হয়নি তা এখনও জানা নেই। গঠনতন্ত্রে কথা শুধু সংবাদ মাধ্যমেই পাচ্ছি। হাতে পেলে প্রশাসনের প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের প্রতিক্রিয়া জানাব।’
এদিকে সভাপতি হিসেবে উপাচার্যের সব ক্ষমতার বাতিল চেয়েছে শিবির। সংগঠনটি তাদের সংস্কার প্রস্তাবে উল্লেক করেছে যেহেতু সভাপতি অনির্বাচতি, তাই সভাপতির সব নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করতে হবে এবং এটি একটি আলঙ্কারিক পদ হিসেবে চেয়েছে তারা।
ঢাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন, যে পরিমার্জন করা হয়েছে, তা প্রস্তাবের তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল। আমরা মনে করি এই সংস্কার কার্যক্রম দিয়ে ডাকসু চললে তা খুব বেশি কার্যকর হবে না। যেহেতু এই সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিবর্তনের প্রস্তাব রেখেছে। তবে আমরা চাই এই সংস্কার কাজ অব্যাহত থাকুক।
তিনি আরও বলেন, ডাকসুতে নির্বাচিত কমিটি যেন এই গঠনতন্ত্র পুনোরায় সংশোধন করার সুযোগ পায় সে ব্যবস্থা রাখার দাবি আমাদের। এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে ডাকসু সংস্কারের কোন দাবি যেন ডাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। একটি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে অতি দ্রুত ডাকসু নির্বাচনই আমাদের প্রত্যাশা।
গঠনতন্ত্রে নতুন খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, আমরা খেয়াল করেছি যে নতুন প্রস্তাবে বয়সের ক্ষেত্রে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি যে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আট বছর করার জন্য। তবে নানা ব্যস্ততার কারণে এখনো খসড়া প্রস্তাবনা নিয়ে বসা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন এই প্রস্তাব নিয়ে আমাদের অবস্থান তুলে ধরব।