ঢাবিতে প্রথমবারের মতো ‘তা’মীরুল মিল্লাত’ ব্যানারে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রাম
- ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৪:২২ PM , আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৪:২২ PM

“কখনও বন্ধুমহলে নিজের প্রাণপ্রিয় মাদ্রাসার নাম বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম না। সারাক্ষণ ভয় থাকতো যে কখন না কেউ আমার মাদ্রাসার কথা জেনে যায় আর আমাকে হল থেকে বের করে দেয়। মিল্লাতের নাম শুনলেই শিবির ট্যাগ আর তারপরতো পিটিয়ে মেরে ফেলাও জায়েজের মতো ছিল।”— ঠিক এভাবেই ক্যাম্পাস জীবনে মাদ্রাসার পরিচয় নিয়ে শঙ্কার গল্প শোনালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াজুল ইসলাম।
রিয়াজুল আরো বলেন, ‘আমার মনে পড়ে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য কোচিং করতাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভাইরা একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের কিছু সার্ভাইভাল স্কিলও শেখাতেন। চান্স পাওয়ার পরতো একজন একজন করে ডেকে ডেকে এক ধরনের হাতে কলমে শেখাতো যে কীভাবে কলেজ হিসেবে মিল্লাতের নাম না বলে পরিচিত অন্য কোন কলেজের নাম বলে ছাত্রলীগের বড় ভাইদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।’
রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘এর জন্য আমরা পাঞ্জাবি পরাও বাদ দিতাম। এভাবেই কেটেছে আমাদের দিন। অথচ প্রতিবছর মিল্লাত থেকে প্রায় অর্ধশতেরও বেশি শিক্ষার্থী ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ পায়। তাদের সবাইকেই এই অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’
শুধু এই শিক্ষার্থী নয়, একি সুরে কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হান্নান মাসুদ। তিনি তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার আলিম ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা মিল্লাতের নাম ভয়ে বলতে পারত না। তবে আমি বলে গেছি এবং সারাজীবন বলে যেতে চাই। এই জুলাই আন্দোলনে মিল্লাতের শিক্ষার্থীদের অবদান অনেক। মিল্লাতের অনেকজন শহীদ হয়েছেন। একসময় মিল্লাতের শিক্ষার্থীরা এই জাতিকে নেতৃত্ব দিবে।’
বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের মাঠে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ইফতার মাহফিল ও নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩-২৪ এবং ২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের মোট ৯০ জন শিক্ষার্থীকে নবীনবরণ দেওয়া হয়। তা’মীরুল মিল্লাহ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত ঢাকাস্থ মোট চারটি ক্যাম্পাসের শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
প্রথমবারের মতো নিজ মাদ্রাসার ব্যানারে মিল্লাতে শিক্ষার্থীদের এমন আয়োজন রূপ নেয় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। দীর্ঘদিন পর পরিচিত মুখগুলো এক ব্যানারের নিচে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন অনেকেই; তৈরি হয় এক আনন্দঘন পরিবেশ।
অনেকেই জানান, অনুষ্ঠানে এসে তারা তাদের অনেক সিনিয়র, সহপাঠী এবং জুনিয়রদের সাথে পরিচিত হন। এমনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শেরশাহ আলী খান। তিনি বলেন, ‘হলের অনেক ভাইকে আজকে প্রোগ্রামে দেখতে পেলাম। অনেক জুনিয়রকে দেখলাম। পরিচিত মুখগুলোকে এক ভিন্ন পরিবেশে দেখত পাওয়ার যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশের নয়। অথচ এতদিন নিজের মাদরাসার থেকে কারা আসতো কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতো বলতে গেলে খুব কমই জানতাম আমরা। আমার কাছে নতুন স্বাধীনতা মানে এটাই।’
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, মিল্লাতের শিক্ষার্থীদের জন্য এমন অনুষ্ঠান গতবছরও ছিল কল্পনাতীত বিষয়। গত বছরও ইফতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটে শুধু এই ট্যাগ দিয়ে যে এটা শিবির। আর এই ট্যাগ সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয় যখন জানতে পারতো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল মিল্লাত মাদ্রাসা। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া যে আমরা সেই জুলুমের যুগ অতিক্রম করে এসেছি। আশা করি শিক্ষার্থীরা তাদের এমন শিক্ষার্থী বন্ধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।
এসময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. শামছুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. যুবায়ের এহসানুল হক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জহিরুল ইসলাম, ইসলামিক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক, বিশ্বশান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু সায়েম, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা মিরহাজিরবাগের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী।
আরো উপস্থিত ছিলেন, সাফির একাডেমির চেয়ারম্যান ড. আবুল কালাম আজাদ, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গী শাখার অধ্যক্ষ ড. হিফজুর রহমান, উপাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কুরবাণ আলী, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা মিরহাজিরবাগ শাখার শিক্ষক মুহাদ্দিস আব্দুল গাফফার মাক্কী, তা’মীরুল মিল্লাত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হাবিবুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা মিরহাজিরবাগের সাবেক শিক্ষার্থী হোসাইন আহমাদ জুবায়ের এবং পরিচালনা করেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা টঙ্গীর সাবেক ভিপি আবদুল্লাহ আল মিনহাজ।