মাদক কারবারিকে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায় জাবি ছাত্রলীগের ৬ নেতার
- জাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০৬ AM , আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০৬ AM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাঙামাটি এলাকা থেকে স্থানীয় এক মাদক কারবারিকে তুলে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৬ নেতার বিরুদ্ধে। এরপর তাকে মারধরের পর ‘নকল মাদক’ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কাছে তুলে দেয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।
মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ, এহসান ইমাম নাঈম ও সাজ্জাদ শোয়াইব চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়, অর্থ সম্পাদক মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ এবং উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজী।
রবিবার রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েক নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাঙামাটি এলাকায় যান। সেখানে তারা স্থানীয় মাদক কারবারি ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চুকে মারধর শুরু করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু ছাত্রলীগের ওই নেতারা তাকে ছেড়ে না দিয়ে রিকশায় তুলে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফরিদের পরিবারের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় একজন ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। শেষে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার শর্তে ফরিদকে ছাড়তে রাজি হয় তারা। এরপর রাত দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন গেরুয়া বাজারে গিয়ে ছাত্রলীগের দুই নেতার কাছে ৫০ হাজার টাকা হস্তান্তর করেন আপেল মাহমুদ নামে ফরিদের পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তি।
সোমবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এহসান ইমাম নাঈমের ফোন পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের পাশের সুইজারল্যান্ড এলাকা থেকে ওই মাদক কারবারিকে নিয়ে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা।
এর আগে ৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে ফরিদের মাথা ফাটিয়ে দেন সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয়। সে সময় তারা ফরিদের কাছে থাকা টাকাপয়সাও ছিনিয়ে নেন।
ফরিদ হোসেনের স্ত্রী শিরিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা আমার স্বামীকে মাদক কারবারের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা আমার স্বামীকে কয়েকবার মারধর করেছে।
রবিবার রাতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আমার স্বামীকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায়। আমি তাদের চিনি না। তবে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয় যেহেতু আগে মাথা ফাটিয়েছিল, সেহেতু তাদের নির্দেশেই তুলে নিয়ে যেতে পারে—জানান শিরিন আক্তার।
তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রলীগ নেতারা ফোন দিয়ে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। তবে আমরা দুই লাখ টাকা দিতে অপারগতা জানালে তারা ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। পরে আমাদের পরিচিত আপেল মাহমুদ ভাইয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখা থেকে ফোন পাই, আমার স্বামী তাদের হেফাজতে আছেন।
আপেল মাহমুদ বলেন, ছাত্রলীগ নেতারা ফোন দিয়ে ফরিদের পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। তখন ফরিদের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি আমাকে জানালে, আমি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে দুইজন ছাত্রলীগ নেতার কাছে দিয়ে আসি। রাতের অন্ধকারে আমি তাদের চিনতে পারিনি। তবে এহসান ইমাম নাঈম, সাব্বির হোসেন নাহিদ, মেহেদী হাসান জয়, সাজ্জাদ হোসেন, মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ ও আল রাজী সরকার এতে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে বলে ধারণা করছি। কারণ তারা এর আগেও কয়েকবার এসে টাকা দাবি করেছে।
ফরিদ হোসেন বলেন, চারজন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইজারল্যান্ড এলাকায় নিয়ে মারধর করেন। তারা আমার পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। তাদের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন, মো. তৌহিদুল ইসলাম তাকীদ ও আল রাজী সরকারকে চিনতে পেরেছি। বাকি একজনকে চিনতে পারিনি। এছাড়া ফোনে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয়ের সাথে বার বার যোগাযোগ করছিলেন তারা। এরপর ভোরে কিছু নকল ইয়াবা ও ফেনসিডিলের বোতলে পানি ভরে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার কাছে ধরিয়ে দেয়।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাব্বির হোসেন নাহিদ, এহসান ইমাম নাঈম, মেহেদী হাসান জয় ও আল রাজী সরকার। তাদের দাবি, এ ধরনের কোনো কাজের সঙ্গে তারা জড়িত নন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে তৌহিদুল ইসলাম তাকীদকে ফোন দেয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেয়। পরে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আর সাজ্জাদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান লিটনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা) জেফরুল হাসান চৌধুরী সজল বলেন, ভোরে মওলানা ভাসানী হলের শিক্ষার্থী এহসান ইমাম নাঈম ফোন দিয়ে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদিপ্ত শাহিন স্যারকে ঘটনাটি জানায়। তখন সুদিপ্ত শাহিনের নির্দেশে নিরাপত্তারক্ষী নূর এ আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হল সংলগ্ন সুইজারল্যান্ড এলাকায় গিয়ে ওই মাদক কারবারিকে নিয়ে আসেন। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানালে তারা এসে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে তাকে নিয়ে যায়।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. নূর আলম মিয়া বলেন, ফরিদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মাদক আইনে মামলা করা হয়েছে। তবে তার কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে নকল ইয়াবা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে সবগুলো ইয়াবা মনে হয়নি, নকলও রয়েছে। তবে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের এটা পরীক্ষা করতে হবে বলেও জানান তিনি।