রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সবচেয়ে বেশি পিএইচডি আরবিতে, কম বাংলায়
- মেশকাত মিশু
- প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৩, ০৩:৩৫ PM , আপডেট: ১৫ জুন ২০২৪, ০৩:৪৮ PM
দেশের অন্যতম শীর্ষ উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোয় পিএইচডি বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি এই উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে আরবি বিভাগ থেকে। আর সবচেয়ে কম বাংলা বিভাগে।
সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২০তম সিন্ডিকেট সভায় ৩০টি পিএইচডি ডিগ্রি অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরমধ্যে কলা অনুষদ থেকে পেয়েছে ৮ টি; যেখানে শুধু আরবি বিভাগ থেকেই পেয়েছে ৫টি। একই সময়ে কৃষি অনুষদের সব বিভাগ মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৫টি পিএইচডি। বিপরীতে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ মিলিয়ে পিএইচডি ডিগ্রী পেয়েছে মাত্র ২ জন। যেখানে প্রকৌশল অনুষদ থেকে একটিও পিএইচডি আসেনি।
অন্যদিকে, ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি ৫১০তম সিন্ডিকেট সভায়ও ৩০টি অভিসন্দর্ভ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে। এর মধ্যে কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে ছিল ১২টি। একই সময়ে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কৃষি মিলিয়ে অভিসন্দর্ভ ছিল মাত্র ৬টি। আর ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ৪৭৮তম সিন্ডিকেটে ৫৭টি পিএইচডি ডিগ্রি অনুমোদন দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন। যেখানে সব অনুষদ, ইনস্টিটিউটকে পেছনে ফেলে ১৬টি পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয় কলা অনুষদভুক্ত কয়েকটি বিভাগের বিপরীতে। যা বেশ কয়েকটি ইনস্টিটিউটের প্রাপ্ত মোট পিএইচডির সমান।
এটাও ঠিক আমরা যে-ধরনের যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল দরকার চাহিদা মতো দিতে পারি না। কিন্তু সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং অন্যান্য জায়গা থেকে ফান্ড আসছে। কিন্তু কাজে লাগানো যাচ্ছে না বা শিক্ষকরা নিচ্ছেন না—অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, উপ-উপাচার্য, রাবি
তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি (২০২৩) পর্যন্ত ৭ বছরে মোট ছয় শতাধিক পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭টি সিন্ডিকেটে পাশ হওয়া পিএইচডি ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে কলা, চারুকলা, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বিষয়গুলো। পিছিয়ে আছে প্রকৌশল, আইন, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, বিজ্ঞান ও প্রকৌশশের মত বিভাগগুলোয় গবেষণা কঠিন। সে তুলনায় ভাষা বা কলায় অনেকটা সহজ। বিজ্ঞানভিত্তিক বিভাগের একটি গবেষণা করতে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হয়। আবার সাথে একটা নির্দিষ্ট সময়ের চাপ থাকে। ফলে এটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, কোন অনুষদ বা বিভাগ কতজন পিএইচড গবেষক নিতে পারবেন- সেটা নির্ভর করে পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের উপর। সেখানে গবেষণা তত্ত্বাবধান করতে সক্ষম কতজন শিক্ষক আছেন, তারা কতজন নিতে পারবেন তার নিয়ম আছে। সেসব মেনে গবেষণা প্রস্তাবনা আসলে উপযুক্ত কিনা তাতে এক্সপার্টদের মতামত নিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়। স্বভাবতই একেক অনুষদ বা বিভাগের পিএইচ সংখ্যা কম-বেশি হয়।
ভাষায় পিএইচডি বেশি
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৭টি সিন্ডিকেটেই পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ। গত সাত বছরে ৩৪টি পিএইচডি পেয়ে বিভাগভিত্তির সবার উপরে অবস্থান করছে বিভাগটি। যেখানে এর আশেপাশেও যেতে পারেননি অন্য কোনো বিভাগ। আরবি ছাড়াও কলা অনুষদভুক্ত বিভাগের মধ্যে ভাষা সম্পর্কিত বিভাগগুলোই পিএইচডি দেয়ার ক্ষেত্রে জয়জয়কার।
১৩০ পিএইচডির মধ্যে অর্ধেকই হয়েছে আরবি, বাংলা, ফারসি, সংস্কৃতের মতো ভাষাগুলোর উপর। আবার সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ২৮টির মধ্যে ১৯টি পিএইচডিই হয়েছে ফোকলোর এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। কৃষি অনুষদ থেকে বিভাগের হিসাবে এগিয়ে আছে ফিশারিজ বিভাগ। এ বিভাগ থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯টি পিএইচডি ডিগ্রী পাওয়া গেছে। আবার বিজ্ঞান অনুষদে সবচেয়ে বেশি ১৯টি পিএইচডি হয়েছে পরিসংখ্যান বিভাগে।
কোন বছরে কত?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নেয়ার পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে ৫০৭ তম সিন্ডিকেটে একসঙ্গে ৫০ টি পিএইচডি পাশ হয়। দায়িত্ব নিয়ে একবছরে সর্বোচ্চ ৪টি পিএইচডির ফলাফল সিন্ডিকেটে পাস করেছেন তিনি। সর্বশেষ ৫২০তম সিন্ডিকেট পর্যন্ত ৬ সিন্ডিকেটে ১৩৮টি পিএইচডি পাশ করা হয়েছে তার সময়ে। এ সময়েও নামের আগে ডক্টর লাগানোর তালিকায় উপরের দিকে স্থান পেয়েছে কলা অনুষদ। ১৩৮টির মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৫টি পিএইচডি গেছে কলা অনুষদে। যদিও তা আগের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। যেখানে (৪৮৬ থেকে ৫০৪) মোট ৬ সিন্ডিকেটে ৫৩ পিএইচডি ছিল কলা অনুষদভিত্তিক।
বিজ্ঞান-প্রকৌশলের দ্বিগুণ কলায়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পিএইচডির ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২টি বিভাগ থেকে মাত্র ৪টি পিএইচডি করে সবার নীচের রয়েছে আইন অনুষদ। যেখানে আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ থেকে একটিও পিএইচডি পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের বিভাগগুলো থেকে করা পিএইচডি ডিগ্রির মোট সংখ্যার দ্বিগুণ পিএইচডি নিয়েছেন কলা অনুষদভুক্ত বিভাগগুলো।
একইসঙ্গে বিজ্ঞান অনুষদের মাত্র ৬৯টি পিএইচডির দ্বিগুণের কাছাকাছি অর্থাৎ ১৩০টি পিএইচডি গেছে কলা অনুষদে। শতাংশের হিসাবে ৩৭ শতাংশ পিএইচডি হয়েছে কলা অনুষদে।
গত ৭ বছরে প্রকৌশল অনুষদে পিএইচডি নেয়ার প্রবণতা কমেছে।
হিসাব কষে দেখা গেছে, সমান ৮ শতাংশ করে পিএইচডি পাওয়া গেছে সামাজিক বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদে। যদিও সংশ্লিষ্টদের দাবি, বৈশ্বিক র্যাঙ্কিয়ে উপরের দিকে থাকা উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার প্রবণতা বেশি প্রকৌশল সম্পর্কিত বিভাগগুলোর। পাশাপাশি, ফান্ডিং ও অবকাঠামো ঘাটতি আছে প্রকৌশলের বিভাগগুলোতে।
বিজ্ঞান-কৃষি বনাম কলা
বিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণার জন্য যে ধরনের ভৌত অবকাঠামো থাকা উচিত তা একেবারেই নেই বললেই চলে। এটা খুবই অপরিহার্য একটা বিষয়। একই সাথে উন্নত বিশ্বে পিএইচডি গবেষণার জন্য আলাদা ফান্ড থাকে, যা তত্ত্বাবধায়ক এবং সংশ্লিষ্ট গবেষকরা ব্যয় করবেন। এখানে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য ফান্ড খুবই অপ্রতুল। যা ফান্ড দেয়া হয় তা দিয়ে মানসম্পন্ন গবেষণা করা সম্ভব না—অধ্যাপক সালেহ হাসান নকিব
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট পিএইচডি ডিগ্রির ১৯ শতাংশ বিজ্ঞান অনুষদ সম্পর্কিত বিভাগগুলোতে এবং ১৮ শতাংশ হয়েছে কৃষি অনুষদের বেশ কয়েকটি বিভাগে। একই সময়ে, উভয় অনুষদের মোট পিএইচডির সমান ৩৭ শতাংশ পিএইচডি হয়েছে এককভাবে কলা অনুষদে। কেন এমন পরিসংখ্যান? জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকিব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলা, ভাষা বা সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় গুলোর গবেষণা কম ফান্ডে সম্ভব হয়ে যায় যার জন্য ভাষা, সাহিত্যের ক্ষেত্রে পিএইচডি গবেষণা এতো বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
পাস হওয়া পিএইচডি'র মান সম্পর্কে জানতে চাইলে সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি হননি অধ্যাপক নকিব। তবে তিনি বলছেন, যারা পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন তাদের গবেষণার ফলাফল, ডিগ্রি নেয়ার পরবর্তী সময় গুলোতে তাদের গবেষণা কার্যকলাপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা উচিত। পিএইচডিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। তাহলেই বুঝা যাবে পিএইচডিগুলো পদোন্নতির জন্য করা হচ্ছে কিনা।
সামগ্রিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম সঙ্গে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোর কমতি, শিক্ষকদের গবেষণা বিমুখতা, ফান্ড ব্যবহার করতে না পারার পাশাপাশি ফলপ্রসূ গবেষণায় জোর দেয়ার কথা বলেন।
বিজ্ঞান, প্রকৌশল বা কৃষিতে গবেষণা কঠিন কিন্তু ভাষা বা কলায় অনেকটা সহজ। প্রকৌশল বা জীববিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে একটা বিষয়ে গবেষণা করতে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ করতে হয়। আবার সাথে একটা নির্দিষ্ট সময়ের চাপ থাকে। ফলে এটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং—অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম
তার বক্তব্য, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণা বিমুখতা আছে। সেটা আপনারা তাদের সিভি দেখলেই বুঝতে পারবেন কে গবেষণামুখী আর কে গবেষণা বিমুখ? দেখা যাচ্ছে কারো কারো প্রোফাইলে গবেষণা বা পাবলিকেশন নাই বললেই চলে।অধ্যাপক সুলতান বলেন, এখানে কোন অনুষদ, বিভাগ বা ইন্সটিটিউট কতজন নিতে পারবে সেটা নির্ভর করে পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের উপর।
এখন আমরা বিভিন্ন মিটিংয়ে শিক্ষকদের নির্দেশনা দিচ্ছি যেন দেশ, জাতি, বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ উপকৃত হয় এমন আউটকাম বেজড (ফলপ্রসূ) গবেষণার পরিমাণ বাড়ে। যেন গবেষণার ফলাফল মানুষের কাজে লাগে সে রকম গবেষণা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে—যুক্ত করেন অধ্যাপক সুলতান।