উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে এখনও পিছিয়ে নারীরা
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৩, ০২:০১ PM , আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৩, ০৩:৪৪ PM
দেশে বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়েও বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরিতে অনেক পিছিয়ে নারীরা। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী মাত্র ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ ২৮ শতাংশ হলেও গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাত্র ১৭ শতাংশ নারী। তাহলে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতার সমাজ-কাঠামোয় পরিমাণগত অগ্রগতিকে পাশ কাটিয়ে কতটা গুণগত অগ্রগতিতে এগিয়েছে দেশের নারী সমাজ?
শিক্ষা ও নারী উন্নয়ন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক কাঠামোয় এখনও শৃঙ্খলিত নারীরা। পারিবারিক এবং আর্থিক কাঠামোয় নারীকে নির্ভর করতে হয় পুরুষের উপর। সামনে এগিয়ে যেতে নানা কটু-কথার পাশাপাশি নারীদের শিকার হতে হয় সহিংসতার মতো ঘটনারও। এছাড়াও বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দৃষ্টান্তমূলক ন্যায়বিচারের উদাহরণ সৃষ্টি করতে না পারায় এখনো নারীদের সমাজ কাঠামোয় বাস করতে হয় অনেকটা সীমাবদ্ধ গণ্ডিতেই।
পাশাপাশি সমাজে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাও কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নারীর মানুষ হিসেবে বাঁচার প্রশ্নকে। এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মকেন্দ্রিক-সামাজিক-প্রতিযোগিতা ও কাঠামো থেকে বেরিয়ে নিশ্চিত করতে হবে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং নারীকে বাঁচতে দিতে হবে মানুষ হিসেবে; সমান অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নেও দিতে হবে সমান সুযোগ। তবেই, সমাজ রাষ্ট্র বিনির্মাণে আসবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
সূত্র: ব্যানবেইসের বার্ষিক প্রতিবেদেন
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় শতকরা ৪৯ দশমিক ৫০ শতাংশ ছাত্রী। মাধ্যমিকে এ হার ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ৫১ দশমিক ৮৯ শতাংশ হলেও সবচেয়ে কম উচ্চশিক্ষায়; যা শতকরা হিসেবে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। বর্তমানে দেশে মোট ২ কোটি ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৭৮৩ জন, শতকরায় যা ৫০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চশিক্ষায়তনে মোট নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৭৪৪ জন।
সামগ্রিক বিচারে শিক্ষায় নারীর সরব অংশগ্রহণ থাকলেও তার বিপরীত চিত্র কর্মক্ষেত্রে। সরকারি চাকরির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, সরকারি চাকরিতে শিক্ষক ও চিকিৎসকদের মধ্যে নারীর হার তুলনামূলক বেশি। এ হার বেশির ক্ষেত্রে কাজ করছে কোটা, পছন্দ এবং আর্থ-সামাজিক দায়বদ্ধতা। বর্তমানে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৮৪ শতাংশ কোটা সুবিধায় নিয়োগ পান নারী প্রার্থীরা। ফলে বর্তমানে প্রাথমিকের শিক্ষকতায় ৬১ দশমিক ৩৫ শতাংশই নারী। বিপরীতে মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকের হার ২৮ দশমিক ৮২ শতাংশ; ২০১২ সালে যে হার ছিল ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর উচ্চমাধ্যমিকে এ হার আরও কম, মাত্র ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষকের হার কিছুটা বেশি ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। আর সামগ্রিক চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ২৮ শতাংশের মতো।
দেশে বিসিএসসহ নানা প্রতিযোগিতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা ব্যাপক না হওয়ায় সমাজে নারীর শক্ত কোনো অবস্থানের জানান দিতে পারছে না; যার ফলে নারীদের জন্য খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে না আর্থ-সামাজিক কাঠামোয়।
সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে চাকরির জন্য সুপারিশকৃত ২ হাজার ২০৪ জনের মধ্যে ১ হাজার ৬১১ জন (৭৩.০৯%) পুরুষ এবং নারী ৫৯৩ জন (২৬.৯১%)। এর আগে ৩৭তম বিসিএসে সুপারিশকৃত ১ হাজার ৩১৩ জনের মধ্যে ৯৯০ জন (৭৫.৪০%) পুরুষ এবং নারী ৩২৩ জন (২৪.৬০%)। তবে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে নারীর চাকরি পাওয়ার সংখ্যাটি পুরুষদের প্রায় সমান। ৪২তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশকৃত ৪ হাজার জনের মধ্যে ২ হাজার ৩৯ জন (৫০.৯৮%) পুরুষ এবং নারী ১ হাজার ৯৬১ জন (৪৯.০২%)।
সূত্র: পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সরকারি চাকরিজীবীদের তথ্যসংক্রান্ত ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার সীমাবদ্ধ রয়েছে ২৭ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যেই। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিসিএসের মাধ্যমেও চাকরিতে নারীর হার খুব একটা বাড়ছে না এবং শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণী পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। সরকারের ৭৭ জন সচিবের মধ্যে নারী মাত্র ১০ জন। আর বর্তমানে দেশের ১৫ লাখেরও অধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নারী ৪ লাখ ১৪ হাজারের মতো।
বিভিন্ন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সুপারিশপ্রাপ্ত নারী-পুরুষ প্রার্থীদের তুলনামূলক চিত্র
এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও সীমিত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কো‘র তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশ নারী (স্নাতকে এ হার ৪৪ ও স্নাতকোত্তরে ৫৫), এবং পিএইচডি পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ। বৈশ্বিক হিসেবে উচ্চশিক্ষায় নারী পুরুষের প্রায় সমকক্ষ হয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ।
সম্প্রতি গবেষণা নিয়ে কাজ করা সম্মানজনক ‘নেচার সাময়িকী’র এক গবেষণায় বলছে, ৮৩ হাজার গবেষণাপত্রের মাত্র ১৭ শতাংশের প্রধান গবেষক ছিলেন নারী। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো‘র (ব্যানবেইস) ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী শিক্ষার্থীর হার মাত্র ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়াও একই অবস্থা দেশের প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও।
সূত্র: ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ তথ্য মতে, ২০২১ সালে বুয়েটে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ৬২২ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫৮৯ জন ছিল নারী শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার ৬২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬ হাজার ২২৩ জন ছিল নারী শিক্ষার্থী।
ইউজিসির ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ব্যানবেইস বলছে, দেশে ১৬০টি সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে ২৯% ও ৩৬%।
বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় এখনো সর্ব ক্ষেত্রে তথা নীতিমালার ক্ষেত্রেও সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য রয়ে গেছে-জানিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশু অধিকার এবং নারী সমতা নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন ও মানবিক সংস্থা ‘প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল’র প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফারজানা বারি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলছেন, এ বৈষম্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তাদের অংশগ্রহণ এখনও খুবই কম বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। এর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক, অবৈতনিক ও কৃষিকাজের মতো কাজে তাদের অবদান সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে; তবে, দেশে এখনো পারিবারিক বিষয় যেমন: বিবাহ তালাক, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার বিষয়ে আশানুরূপ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
দেশের জনশক্তির একটি বড় অংশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ফারজানা বারি দায়ী করছেন পরিবারের সমর্থনের অভাব, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক দায়বদ্ধতাকে। তিনি বলছেন, পরিবারের সমর্থনের অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় নারীর জীবন ব্যর্থতায় ডুবে যায়। গর্ভাবস্থায় নারীর বাড়তি যত্ন তথা শারীরিক প্রতিকূলতাকে পুঁজি করে সন্তান লালন পালনের গুরু দায়িত্বের দোহায় দিয়ে অনেক নারীকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে হতে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয়। বর্তমানে বিভিন্ন মিডিয়ার বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে এবং করোনার সময় যখন সারা বিশ্ব স্থবির হয়ে ছিল তখনও অনেক নারী পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার হয়েছেন।
নারীর অগ্রগতিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও সমর্থন দরকার এবং পরিবার থেকেই এ পরিবর্তনের কাজ শুরু করতে হবে জানিয়ে নারী সমতা নিয়ে কাজ করা সংস্থাটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক বলছেন, সমস্যা সমাধানে পর্যায়ক্রমে কাজ করতে হবে বিদ্যালয়, সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও। তিনি মনে করেন, জেন্ডার সংবেদনশীল একীভূত শিখন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল শিশুর প্রতি সমদৃষ্টি প্রদান সম্ভব। জেন্ডার সম্পর্কিত গতানুগতিক ধারনা সম্পর্কে সকল বয়সের নারী পুরুষকে অবহিত করা ও ক্ষতিকর নিয়ম নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে পরিবর্তন আনা সম্ভব, আয়-বর্ধনমূলক কর্মসূচীর মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি, মেয়ে শিশু বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে শিশুরা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে অবদান রাখতে পারবে-যুক্ত করেন ফারজানা বারি।
যেকোনো পরিবর্তনের প্রভাব সবসময়ই নারীর উপর পড়ে; কোভিড-১৯ ও বৈশ্বিক নানা প্রভাব দেশে পড়েছে এবং যার ফলে দেশের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, পরিবর্তনের যে প্রভাব তা নেতিবাচক-ভাবেই পড়ে নারীদের উপর। যখন কোনো কাট-ছাট বা সংকোচনের প্রশ্ন আসে তখনই বাদ দেওয়া হয় নারীদের। কোভিড-১৯ এর বিরূপ প্রভাব নারীদের উপর পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা সংখ্যাভিত্তিক উন্নয়ন কাঠামোয় আটকে গেছি; যেখানে উন্নতির মাপকাঠি বিচার করা হয় আর্থিক মানদণ্ডে, যার ফলে নারীর অগ্রযাত্রা একটি কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে; আমাদের এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে।
দেশের নারীরা এখন অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করছে জানিয়ে ড. তানিয়া হক বলেন, মেয়েরা এখন এগিয়ে যাচ্ছে; সরকার সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে কাজ করছে এবং তার সুফলও আসছে। তবে আমাদের সমাজে এখনো অনেক পুরুষ নারীর প্রতি নানা রকম সহিংসতা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে থাকে, যা আমাদের পীড়া দেয়। তিনি বলেন, আমরা সামাজিক বাধার কারণে নারীর জীবনকে এখনো একটি বড় জায়গায় দেখতে পারি না। নারীরা এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে; সেজন্য সমাজে যেন এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে; যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে। গবেষণাসহ নানা খাতে বা প্রতিযোগিতামূলক খাতে নারীর অবস্থান তুলনামূলক কম বলার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দুই দশক আগের চিত্র বিচার করতে হবে; সে হিসেবে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে।
চলমান ব্যবস্থায় ঢালাওভাবে কোনো পক্ষের উপর দোষারোপ না করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অবৈতনিক সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ অধ্যাপক সমাধান দেখছেন সমাজে সকলের ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠাকে। তিনি বলেন, প্রথমত বাবা-মা তার সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তার সুস্থ এবং সুন্দর মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে যেন সে মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি তাদেরও ভালো মানুষ হতে হবে। এছাড়াও বর্তমানে গণমাধ্যমে সহিংসতার যেসব সংবাদ ছাপা হয় তা বন্ধ করতে হবে। কারণ এটি নতুন করে সহিংসতাকে উস্কে দেয়। একইসাথে অনলাইন দুনিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে নারীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। আমরা প্রতিযোগিতা-মূলত যে সমাজে বাস করছি তাতে প্রদর্শন-ইচ্ছার ফলে আমরা একটি আত্মকেন্দ্রিক সমাজ কাঠামোয় চলে এসেছি, এখান থেকে আমাদের বের হতে হবে; সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে; সবাইকে সাথে নিয়েই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে-যুক্ত করেন অধ্যাপক ড. তানিয়া হক।
সূত্র: ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য ও এডুকেশন ওয়াচ’র উপদেষ্টা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, আমাদের এখনো সমান হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে মানসিকতা থাকা দরকার তা গড়ে ওঠেনি। বহু সংস্কার ও কুসংস্কারে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে অনুকূল পরিবেশের অভাবে নারীরা কারিগরি শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে আছে। নারীর পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণে হিসেবে তিনি মনে করেন, নারীকে তার পছন্দমতো কাজ করতে না দেওয়া বা তাকে একটি ফরমায়েশি ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ রাখা। নারীকে তার পছন্দের এবং জীবনের অভ্যস্ততার সাথে মানানসই এমন বিষয় নিয়ে গবেষণার সুযোগ দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর্মজীবী নারীদের ঘর সামাল দেওয়া, সন্তান লালন-পালন ও কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করতে হয়, যেখানে পুরুষের ভূমিকা এক পাক্ষিক, শুধু কর্মসংস্থান সামলানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ; তবে, কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, আনুকূল্য পেলে নারী তার সক্ষমতা যেমন প্রমাণ করতে পারে; তেমনি পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতায় সে যে পিছিয়ে থাকছে না, তা প্রমাণ করতে পেরেছে। তিনি বলেন, নারীর উন্নয়নের জন্য যা করা দরকার তা কতটুকু সমাজ বা তার আশ পাশ থেকে পাচ্ছে তা দেখতে হবে। বর্তমানে নারী নিজেরা কিছু উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নে তাদের নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। অথচ নারী যেখানেই অবারিত সুযোগ পেয়েছে সেখানেই তারা নিজেদের প্রমাণ করতে পেরেছে।
নারীর পশ্চাৎপদতা অনেকটা আরোপিত জানিয়ে তিনি বলেন, এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজন সৃজনধর্মী নারী নেতৃত্বে থাকার পরও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোয় উন্নয়নের স্বপক্ষে নারীর জন্য অবস্থার সে অর্থে পরিবর্তন আনতে পারেননি। আমাদের শতাব্দী সাল ধরে চলে আসা কাঠামো ও কুসংস্কারের গণ্ডি পার হতে হলে অনেক বাধা বিপত্তি পার হতে হবে এবং এখানে নারীকেও আরও সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ এগিয়ে গেলেও তার অগ্রগামীতা সকল ক্ষেত্রে সমান নয়, সেজন্য সমাজে নারীর এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে নারীকে সমর্থন করতে হবে; সহায়তা করতে হবে তাদের উদ্যোগকে-যুক্ত করেন অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ।