শীতের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৪ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:০২ PM
শীত মানেই হিমহিম কনকনে ঠাণ্ডার অনুভূতি। ইউরোপ-আমেরিকা বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে বরফ না পরলেও শীতকালে এক অংকের ঘরে নেমে যায়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকে সব থেকে প্রকট। মাঝে মধ্যেই হয় হাড়কাঁপানো শৈত্য প্রবাহ। প্রতি বছর শীতের এই শীতল আবহাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যায়। আর এতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয় শিশু ও বয়স্করা।
শীতের ভাইরাসজনিত জটিল রোগগুলো থেকে বাঁচতে শিশুদের অন্যের হাঁচি-কাশি থেকে দূরে রাখতে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কারণ হাঁচি-কাশিতে থাকা লক্ষ লক্ষ জীবাণু শিশুর শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া বাইরের বিভিন্ন ধরনের খাবার, চা ও পানিতে শীতকালে প্রচুর পরিমাণে জীবাণু থাকায় এসব খাদ্যে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। তাই এসব পরিহার করতেও পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
শীতের সময় বিশেষ করে শিশুদের পোশাক ঠিক মতো না পড়া, বাতাসে ঘনীভূত হওয়া বাতাস শ্বাস নালীর মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করা, ঠাণ্ডা পানি ব্যবহার করা ও পরিষ্কার না থাকাসহ নানা কারণে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ হয়ে থাকে। শীতকালের জটিল ব্যাধি এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী এর লক্ষণ ও প্রতিরোধ-প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত থাকছে এই প্রতিবেদনে।
সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা
শীত কিংবা উষ্ঞ আবহাওয়া, বছরের যে কোনো সময় সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে শীতকাল আসলে এর তীব্রতা বেড়ে যায় বহুগুণে। শিশু, প্রাপ্ত বয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ, সবাই আক্রান্ত হয় এতে। প্রায় ২০০ রকমের ভাইরাসের কারণে সর্দি-কাশি হয়। আক্রান্ত রোগীদের নাক বন্ধ, নাক দিয়ে পানি পড়া, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, শরীর ব্যথা, হাঁচি-কাশি ও জ্বর থাকতে পারে।
পরিমিত পরিমাণে তরল খাবার, কুসুম গরম লবণ পানি দিয়ে গড়গড়া, মধু খাওয়া এবং ঠাণ্ডা পানি ও খাবার পরিহার করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ওষুধের সাহায্য ছাড়াই কয়েকদিনের মধ্যে িসর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তবে শিশু, বৃদ্ধ এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ডাক্তারের পরামর্শের প্রয়োজন হতে পারে।
সর্দি-কাশির তীব্রতর উপসর্গ থাকলে ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি ও নিঃসরিত লালার মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হয়। সাধারণ সর্দি-কাশির অতিরিক্ত উপসর্গ হিসাবে বমি, পাতলা পায়খানা হতে পারে। কয়েকদিনের মধ্যে বেশিরভাগ উপসর্গের উপশম হলেও কাশি ভালো হতে দুসপ্তাহের বেশিও লেগে যেতে পারে।
এ ভাইরাস বছরে বছরে তার ধরন বদলায়। তাই বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক এবং বিভিন্ন জটিল রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের এ রোগ প্রতিরোধে প্রচলিত টিকা প্রতি বছরই নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে অনেক সময় এন্টিভাইরাল ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। তাই উপসর্গের তীব্রতা বেশি হলে শিশু, বৃদ্ধ ও জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সর্দি-কাশি ও ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ প্রতিরোধে বারবার হাত ধোয়া, নাকে-মুখে হাত না দেওয়া এবং আক্রান্ত ব্যক্তির নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্যবহার না করা উচিত।
নিউমোনিয়া
দেশে ঠাণ্ডাজনিত অন্যতম জটিল রোগ নিউমোনিয়া। বেশিরভাগ নিউমোনিয়া হয়ে থাকে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশে শিশুরা সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয় এই রোগে। অনেক শিশুর জীবন সংশয়ও দেখা দেয় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। তবে এতে প্রাপ্ত বয়স্ক ও বৃদ্ধের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। এ রোগ হলে ঠাণ্ডা ও কাঁপুনি দিয়ে তীব্র জ্বরের সঙ্গে কফযুক্ত কাশি, শ্বাসকষ্ট, দ্রুত পালস, প্রেসার কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হতে পারে।
নিউমোনিয়া সন্দেহ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এছাড়া নিউমোনিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বেশ কিছু টিকা নিতে হয়।
সাইনোসাইটিস ও হাঁপানি-অ্যাজমা
সাইনোসাইটিস হলে নাক বন্ধ থাকা, অল্পবিস্তর শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা থাকে। এর প্রতিকারে তেমন এন্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয় না তবে কিছু অ্যালার্জির ওষুধ, ন্যাজাল স্প্রে এবং গরম পানির ভাপেই আরাম পাওয়া যায়।
অন্যদিকে হাঁপানি বা অ্যাজমা সারা বছর হলেও শীতকালে এর তীব্রতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। মূলত শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া এবং ঠাণ্ডা বাতাস ও বিভিন্ন অ্যালার্জির জন্য এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। অ্যাজমার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার হলো চিকিৎসকের পরামর্শে ইনহেলার ব্যবহার করা। তবে যাদের শুধু ইনহেলারে অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণ হয় না, তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের মুখে খাবার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এ জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যাবশ্যক। এছাড়া এসকল রোগ প্রতিরোধের জন্য পরিষ্কার পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন।
বাত ব্যথা ও কানের ইনফেকশন
শীতকাল আসলেই বিভিন্ন ধরনের বাতের ব্যথা বেড়ে যায়। তাই নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি ব্যায়াম করা প্রয়োজন। তবে ব্যথার ওষুধ সেবনে হার্ট, কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এ রোগের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।
এছাড়া শীত আসলেই ঠাণ্ডা আবহাওয়ার জন্য কান ব্যথা, মাথা ঘোরানো, কান দিয়ে পুঁজ পড়া ইত্যাদি থাকতে পারে। ঠিক মতো চিকিৎসা না করালে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে শ্রবণযন্ত্রের স্থায়ী সমস্যা হয়ে যেতে পারে। এজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বাঞ্চনীয়।
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু
শীতকাল আসলেই বিভিন্ন মশাবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা যায়। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, ডেঙ্গু রোগসহ নানা ভাইরাস জ্বরের রোগের প্রকোপ দেখা যায়। যদিও ডেঙ্গু বর্ষাকালীন রোগ তবে শীতকালেও এর বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। এ রোগ হলে কাঁপুনি দিয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার জ্বর আসে। গিঁটে ব্যথাও হতে পারে।
এসব লক্ষণ দেখা গেলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া মশার কামড় থেকে বাঁচতে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মিত মশারি টাঙাতে হবে।
ডায়রিয়া পাতলা পায়খানা
শীত এলেই ঠাণ্ডাসহ অ্যালার্জিজনিত সমস্যার সঙ্গে ভাইরাসঘটিত শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগও আক্রমণ করে। আবার গরম বা বর্ষাকালের রোগ ডায়রিয়া বা উদরাময়ও হতে পারে ভোগান্তির কারণ। এ সময় শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ডায়রিয়া বেশি হতে দেখা যায়, তবে অন্য বয়সের মানুষও আক্রান্ত হতে পারেন। নবজাতকদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া এবং জ্বরও দেখা দিতে পারে। শীতকালে ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের ভাইরাল ডায়রিয়া হয় যাকে রোটা ডায়রিয়া বলে।
ভাইরাসঘটিত ডায়রিয়ায় সাধারণত বিশেষ কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে যান। কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে অ্যান্টিবায়োটিক বা নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজন হতে পারে। তবে, নিরাপদ পানি পান, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রাখা, বাসি খাবার বা বাইরের খাবার এড়িয়ে চলা, খাবার আগে হাত ধোয়া ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হলে এই সময়ের পেটের সমস্যা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
চামড়ার শুষ্কতা
শীতের সময় শুষ্কতার কারণে শরীরের ত্বকও শুষ্ক হয়ে ওঠে। ফলে অনেক সময় চুলকানি বা ব্যথা অনুভব হতে পারে। বিশেষ করে যাদের ধুলাবালিতে অ্যালার্জি আছে তাদের অনেক সময় অ্যালার্জির কারণেও হতে পারে এটি।
এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত লোশন বা অলিভ অয়েল, নারিকেল তেল বা গ্লিসারিন ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে চামড়া স্বাভাবিক থাকবে। এছাড়া চুলকানি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শুরু থেকেই এ ব্যাপারে সতর্ক হলে চুলকানি বা অ্যালার্জি ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ থাকবে না।
শীতকালে রোগ প্রতিরোধে যা করা প্রয়োজন
ধুলাবালি থেকে সতর্কতা—শীতের সময় বাতাসে ধুলাবালি বেড়ে যায়। আর এতে নানা ধরণের ধাতুর উপস্থিতিও থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ থেকে বাঁচতে মুখে মাস্ক পড়ে চলাচল করা উত্তম।
ডায়াবেটিক রোগীদের করণীয়—যাদের ডায়াবেটিক বা দীর্ঘমেয়াদি আছে শীত তাদের রোগের প্রকটতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এজন্য নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করতে হবে।
নিজেকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা—শীতের সময় নিজেকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য গরম কাপড় পরীধান করতে হবে, কান ও হাত ঠেকে রাখতে হবে, গলায় নরম কাপড় ব্যবহার করতে হবে। শিশুরা অনেক সময় শরীরে গরম কাপড় রাখে না বা খুলে ফেলে। তাই তাদের দিকে সতর্ক নজর রাখা উচিত। গোসল, হাতমুখ ধোয়া ও পানি পানসহ সকল ক্ষেত্রে সবসময় কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। এ সময় ঠাণ্ডা খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে।
প্রচুর খাবার পানি পান ও ব্যায়াম—শীতের সময়েও প্রচুর পরিমাণে খাবার পানি পান করতে হবে বলে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। এ সময় রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে এবং শরীর সুস্থ্য রাখতে শীতকালেও নিয়মিতভাবে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে।
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ—ভিটামিন সি অধিকাংশ রোগের জন্য এক প্রকার প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে। তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন জলপাই, কমলা, লেবু ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে।